শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

আজও অমর কফি হাউসের সেই মান্না দে

আজও অমর কফি হাউসের সেই মান্না দে

‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’... সত্যিই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী মান্না দের কফি হাউসের আড্ডা থেমে গেছে তাঁর মহাপ্রয়াণে। এই মহান শিল্পীর চিরপ্রস্থান ঘটলেও কফি কিংবা চায়ের টেবিলে অথবা নানা আলোচনায় আর গানের আসরে আজও মান্না দে জীবন্ত হয়ে ওঠেন অবধারিতভাবে। এই কিংবদন্তি শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সংগীতযোদ্ধা

প্রবোধ চন্দ্র দে তাঁর প্রকৃত নাম। ডাক নাম মান্না দে। ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সংগীতশিল্পী এবং সুরকারের একজন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তিনি ৬০ বছরেরও বেশি সময় সংগীতচর্চা করেছিলেন। বৈচিত্র্যের বিচারে তাঁকেই ভারতীয় গানের ভুবনে সবর্কালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ সংগীতবোদ্ধা।

 

গানের তালিম

শৈশবে পাঠ গ্রহণ করেছেন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক করেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি তাঁর সহপাঠীদের গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং ওস্তাদ দাবির খানের কাছ থেকে গানের শিক্ষালাভ করেছিলেন। ওই সময় মান্না দে আন্তকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা শ্রেণি-বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন। মান্না দে শুরুতে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র অধীনে সহকারী হিসেবে এবং তারপর শচীন দেব বর্মণের (এস ডি বর্মণ) অধীনে কাজ করেন। ওই সময় তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি ওস্তাদ আমান আলী খান এবং ওস্তাদ আবদুল রহমান খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন।

 

প্লে-ব্যাক

১৯৪৩ সালে হিন্দি ‘তামান্না’ চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দের অভিষেক ঘটে। সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈত সংগীতে গান এবং সুরকার ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। গানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়। ‘মশাল’ (১৯৫০) ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠি ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালি’ গানটি গান। এর ফলেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও পাকাপোক্ত করেন এবং জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে সংগীতপ্রেমীদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান। দ্বৈত সংগীতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে প্রথম ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ (শঙ্খবেলা) গানটি করেন।

 

আত্মজীবনী ও রবীন্দ্র ভারতীর পদক্ষেপ

২০০৫ সালে বাংলা ভাষায় তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ খ্যাতিমান আনন্দ প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমোরিজ কাম এ লাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠি ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনূদিত হয়েছে। মান্না দের জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্না দে সংগীত একাডেমি মান্না দের সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা সংগীত ভবনে মান্না দের সংগীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

 

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

মান্না দে গায়ক হিসেবে ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সফল সংগীত ব্যক্তিত্ব। এ ছাড়াও হিন্দি এবং বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে অশেষ সুনাম অর্জন করেছেন। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সংগীত জীবনে রবীন্দ্রসংগীতসহ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান গেয়েছেন মান্না দে। তিনি অসংখ্য শ্যামাসংগীতও করেছেন। সংগীত ভুবনে তাঁর এই অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় ভূষিত করেন। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণ প্রদান করে।

 

যত অর্জন

মান্না দে পদ্মশ্রী এবং পদ্মবিভূষণ খেতাবসহ অসংখ্য রাষ্ট্রীয় খেতাব অর্জন ছাড়াও ১৯৬৯ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র মেরে হুজুর ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার : শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (পুরুষ), ১৯৬৯ সালে জাতীয় ছায়াছবি পুরস্কার জবহধরংংধহপব ঝধহংশৎরঃরশ চধৎরংযধফএর (মধ্যপ্রদেশ), ১৯৭১ সালে বাংলা ‘নিশি পদ্মে’ ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকার পদক, ১৯৮৮ সালে রেনেসাঁ সাংস্কৃতিক পরিষদ, ঢাকা থেকে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯০ সালে মিঠুন ফ্যানসের শ্যামল মিত্র পুরস্কার, ১৯৯১ সালে শ্রী ক্ষেত্র কলা প্রকাশিকা, পুরী থেকে সংগীত স্বর্ণচূড় পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে পিসি চন্দ্র গ্রুপ ও অন্যদের পক্ষ থেকে পিসি চন্দ্র পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে কমলা দেবী গ্রুপ কমলা দেবী রায় পুরস্কার, ২০০১ সালে আনন্দবাজার গ্রুপ আনন্দলোক আজীবন সম্মাননা, ২০০২ সালে বিশেষ জুরি বোর্ড কর্তৃক সারল্য যশোদাস পুরস্কার, ২০০৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক আলাউদ্দিন খান পুরস্কার, ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী কর্তৃক ডি.লিট সম্মাননা, ২০০৪ সালে কেরালা সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার, ২০০৫ সালে মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃক আজীবন সম্মাননা প্রদান, ২০০৭ সালে ওড়িশা সরকারের ‘প্রথম অক্ষয়’ পুরস্কার, ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মান, ২০১১ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মান, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ, ২০১২ সালে তাঁর কৃতিত্বের জন্য ২৪ ঘণ্টা টিভি চ্যানেল আজীবন অনন্যা সম্মান লাভ করেন।

 

জনপ্রিয় গানসমূহ

কফি হাউসের সেই আড্ডাটা, আবার হবে তো দেখা, এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি, তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, যদি কাগজে লিখো নাম, সে আমার ছোট বোন, জিন্দেগি এয়িসি এক পহেলি হ্যায় প্রভৃতি...

 

চিরবিদায়

২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর জীবন খাতার পাতায় সব হিসাবনিকাশ চুকিয়ে জীবনের জলসাঘর থেকে চিরবিদায় নেন মান্না দে।

সর্বশেষ খবর