মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলেন রহমান

সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলেন রহমান

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তারকা তৈরির কারিগর খ্যাত চিত্রপরিচালক এহতেশামের আবিষ্কার অভিনেতা রহমান। এহতেশাম তাঁকে ‘উত্তম কুমার’ নামেই ডাকতেন। আজ অভিনেতা রহমানের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে চলচ্চিত্র জগৎ ও তাঁর দর্শক-ভক্তরা। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। রহমানের অভিনয়ের স্বতন্ত্র স্টাইল এবং ফ্যাশন দর্শকদের মন্ত্রের মতো সিনেমা হলে টেনে নিয়ে যেত। প্রয়াত এই কিংবদন্তি অভিনেতার স্মরণে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ছবির সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলেন

এহতেশাম পরিচালিত ছবি ‘এ দেশ তোমার আমার’-এ রহমান ছিলেন প্রতিনায়ক। নায়ক-নায়িকা আনিস (খান আতা) ও সুমিতা দেবী। প্রথম দিন শুটিংয়ে অংশ নিয়ে অভিনয় করতে পারছিলেন না। বারবার ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখে খান আতা বললেন, এহতেশাম এই ছেলেটাকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন। এ কথা শুনে রহমান শুটিং স্পট থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর একটু আসি কথাটি শুনে সন্দেহ হয় সেটের সবার। রহমান পালিয়ে যেতে পারলেন না। ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। এ ছবিটি হিট হয়, একই সঙ্গে রহমানের অভিনয় প্রশংসিত হয়।

 

এহতেশাম তাঁকে ‘উত্তম কুমার’ ডাকতেন

এহতেশাম শাহবাগ হোটেলে প্রায়ই যেতেন। তাঁর সঙ্গে রহমানের ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় অল্প দিনেই। তিনি তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অফার দেন। এহতেশামের অফার পেয়ে তো রহমান আহ্লাদে আটখানা। তিনি রহমানকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, তুমি দেখতে অবিকল উত্তম কুমারের মতো।

 

রহমান যেভাবে চলচ্চিত্রে

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়া ও অভিনেতা অসিতবরণের ভক্ত ছিলেন রহমান। রুপালি পর্দায় প্রিয় শিল্পীদের অভিনয় দেখতে সন্ধ্যা হলে প্রায়ই ছবিঘরে ছুটে যেতেন। সিনেমা দেখতে দেখতে একসময় চলচ্চিত্রে অভিনয় করার ভূত চেপে বসে তাঁর মনে। কাউকে কিছু না বলেই সিনেমার টানে বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। অজপাড়াগাঁর সেই ছেলেটিই পরবর্তীতে হয়ে গেলেন  চলচ্চিত্রের সাড়া জাগানো নায়ক। রহমানকে তুলনা করা হতো নায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে। তাঁর পুরো নাম আবদুর রহমান। তিনি ১৯৩৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রসেয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ১৯৪৮ সালে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করা, মাঠে ফুটবল খেলা, নয়তো ক্রিকেট খেলে বিকাল পার করতেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নামাজ পড়ে পড়াশোনায় বসে যেতেন। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন রহমান। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেন। সিট পেলেন কলেজ হোস্টেলে। তখন রাজশাহীতে ছিল ‘কল্পনা’ ও ‘অলকা’ ছবিঘর। সন্ধ্যা হলে প্রায়ই ছবি দেখার জন্য ছবিঘরে আসতেন। প্রমথেশ বড়ুয়া নয়তো অসিত বরণের ছবি তাঁর খুব ভালো লাগত। বিকালে বেড়াতে যেতেন পদ্মা নদীর তীরে। মন টিকল না রাজশাহীতে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়েই চলে এলেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন।  সেখান থেকে আইএ পাস করলেন। ১৯৫৮ সালে শাহবাগ হোটেলে চাকরি নেন। ইংরেজি ও হিন্দি ছবি মুক্তি পেলে হলে গিয়ে দেখতেনৎ। সুচিত্রা-উত্তমের সাগরিকা, শাপমোচন, শিল্পী ছবি দেখে চলচ্চিত্র জগতের প্রতি আগ্রহটা বেড়ে যায়। তখন থেকেই ফিল্মে অভিনয় করার শখ ভালো করে চেপে বসে মাথায়। জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে রহমান বলেছিলেন, ১৯৫৮ সালে শাহবাগ হোটেলে রিসিপশনিস্টের চাকরি করি। সেখানে আমাকে কয়েকজন বন্ধু ঠাট্টা করে উত্তম উত্তম বলে ক্ষেপাত। একদিন আমার এক বন্ধু এসে বলল, আমাদের এখানে ছবি  তৈরি হবে সেখানে সুযোগ পেতে পারিস। বন্ধুদের কথামতো গেলাম সেই অফিসে। পরিচালকের নাম ফজলুল হক। ছবির নাম ‘আজান’। রমনা পার্কের পশ্চিমে টেনিস গ্রাউন্ডের সঙ্গে ছোট একটা রুমে অফিস। পরিচালক হক সাহেবের স্ত্রী আমাকে দেখে বললেন, ‘আমি মনে মনে নায়কের ভূমিকায় যে রকম মুখ খুঁজছিলাম ঠিক সেই রকম ছেলে আল্লাহ পাঠিয়েছে। আর কোনো কথা নয়। এই ছেলেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করবে।’ সে দিনই আমাকে নায়ক চরিত্রে নির্বাচন করলেন হক সাহেব। তখন আমার বয়স ১৯ বছর। তবে আমার উচ্চারণে কিছুটা সমস্যা ছিল। তাই বিরোধিতা করেছিলেন অভিনেতা ইনাম আহমেদ। সেদিন যে আমাকে উৎসাহ, অভয়, সাহস ও সহযোগিতা করেছিল তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় চিত্রগ্রাহক মরহুম সাধন রায়। ‘আজান’ ছবির শুটিং শুরু হতে বিলম্ব হওয়ায় এরই মধ্যে এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’-এ অভিনয় করার সুযোগ পাই।

 

‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’

খলনায়ক হিসেবে অভিনীত ‘এ দেশ তোমার আমার’ রিলিজের পর সরাসরি নায়ক হিসেবে অফার পেলেন ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। এ ছবিতে তালাত মাহমুদের গাওয়া- ‘তোমাকে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি রহমানকে এনে দেয় বিশাল পরিচিতি।

 

রহমানের অন্য যত হিট ছবি

১৯৬৫ সালের ১৬ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘বাহানা’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জহির রায়হান ছবিটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র ব্যাপক জয়প্রিয়তা এনে দেয় নায়ক রহমানকে। তাঁর আগের চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ব্যাপক জয়প্রিয় ছিল তৎকালীন দুই পাকিস্তানে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। সেখানে নায়ক রহমান চুনি লালের চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৮১ সালে দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘অংশীদার’ চলচ্চিত্রেও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। রহমান অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ছিল অশোক ঘোষ পরিচালিত নব্বইয়ের দশকে মুক্তি পাওয়া ‘আমার সংসার’।

 

নির্মাতা হিসেবেও সফল

অভিনয়ের পাশাপাশি রহমান বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক, যিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। ১৯৬৭ সালে ‘দরশন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন তিনি। ‘দরশন’ আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। এ ছবিতেও তাঁর নায়িকা ছিলেন শবনম। রহমান পরিচালিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো- ‘মিলন’, ‘কঙ্গন’, ‘যাহা বাজে সেহনাই’, ‘নিকাহ’ প্রভৃতি।

 

যেভাবে পা হারালেন রহমান

‘প্রীত না জানে রীত’ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে শুটিং করার জন্য রহমান গেলেন সিলেটে। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই রহমান একটি পা হারালেন। সেদিন সিলেটে জিপগাড়ি চালাচ্ছিলেন আফজাল হোসেন। পাশে মোহসীন নজরুল বসা। রহমানের একটি পা ছিল বাইরে। মুরারী চাঁদ কলেজের সামনে আসতেই একটি ট্রাক এসে রহমানের এক পা কেড়ে নিল।

সর্বশেষ খবর