রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই ভূপেন হাজারিকা...

সেই ভূপেন হাজারিকা...

২০২০ সালে করোনায় যখন বিশ্ব লন্ডভন্ড তখন অমর কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গানটি ভারতের একটি হাসপাতালে রোগী ও চিকিৎসকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ভূপেন হাজারিকার গান মানবপ্রেম, প্রকৃতি, সমাজবাদ, জীবনধর্মীয় বক্তব্য সমৃদ্ধ। তাঁর কণ্ঠে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী সুর উচ্চারিত হয়েছে। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’প্রাপ্ত এই কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

জীবন বাঁচাতে তাঁর গান

‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? ও বন্ধু...’ ২০২০ সালে ভারতের গুয়াহাটির কালাপাহাড় হাসপাতালে সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ভূপেন হাজারিকার এই মানবিক গানটি বেহালায় সুর তুলে সেই সুরের মূর্ছনায় করোনা চিকিৎসক ও করোনা আক্রান্ত রোগীদের সাহস জোগালেন আরেক করোনা রোগী। বেহালায় সুরের মূর্ছনা তোলা ব্যক্তির নাম সত্যেন্দ্র চৌধুরী। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। আর সেই গানে অভিবাদন জানালেন কভিড ওয়ার্ডের চিকিৎসকসহ অন্য রোগীরা। ১৯৬৪ সালে এই গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দেন ভূপেন হাজারিকা। গানের কথার অর্থ হলো- ‘আরও মানবিক হয়ে মানবজাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা।’ উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো প্রায় ৬০ বছর পরও একজন গায়কের গান আজ মানুষের বিষণ্ন মনকে জাগিয়ে তুলতে পারছে। এমন প্রাপ্তি কজনের ভাগ্যেইবা জুটে। মানবতাবাদী সংগীতশিল্পী হিসেবেই তিনি সংগীতপ্রেমী মানুষের প্রিয়।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর গাওয়া ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ,/জয় জয় মুক্তিবাহিনী/ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে/মৈত্রীর কাহিনি।’ গানটি সবার হৃদয় জয় করে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভূপেন হাজারিকা বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় দেখেছেন বঙ্গ সংস্কৃতির স্ফূরণ। তিনি বাংলাদেশেই বঙ্গ সংস্কৃতির গভীরতা দেখেছেন।

 

যেভাবে গানের ভুবনে

পড়াশোনা শেষে ভূপেন হাজারিকা গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে কলকাতায় চলে আসেন এবং চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। পাশাপাশি আইপিটিএর (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) সক্রিয় কর্মী ও নেতা হিসেবে গণনাট্যের কাজ চালিয়ে যান। এ সময়ই তাঁর গাওয়া গণসংগীতগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শৈশবেই ভূপেন হাজারিকা গীতিকার আনন্দীরাম দাস, পার্বতী প্রসাদ বড়ুয়া ও কমলানন্দ ভট্টাচার্যের মাধ্যমে স্থানীয় বরগীত, গোয়ালপাড়ার গান, চা-মজদুরের গান, বিহুগীতসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন ও প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতি প্রসাদের প্রভাব পড়েছিল ভূপেনের মনে। হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণু প্রসাদ রাভার হাত ধরেই সংগীতে পথচলা শুরু হয় ভূপেনের। অসমিয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত এবং বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

 

‘মানুষ মানুষের জন্যে’ ২০২০ সালে ভারতের একটি হাসপাতালে ভূপেন হাজারিকার এই মানবিক গানটি বেহালায় সুর তুলে করোনা চিকিৎসক ও করোনা আক্রান্ত রোগীদের সাহস জোগালেন আরেক করোনা রোগী

 

উল্লেখযোগ্য যত গান

মানুষ মানুষের জন্যে, আমি এক যাযাবর, হে দোলা হে দোলা, সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল, সহস্র জনে মোরে প্রশ্ন করে মোর প্রেয়সীর নাম, আজ জীবন খুঁজে পাবি, ও মালিক সারা জীবন কাঁদালে যখন, গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা, আজ জীবন খুঁজে পাবি, প্রতিধ্বনি শুনি, চোখ ছলছল করে, মেঘ থমথম করে, শরৎ বাবু খোলা চিঠি দিলাম প্রভৃতি।

 

যত অর্জন

ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পদকে সম্মানিত হয়েছেন ভূপেন হাজারিকা। ২৩তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৭৫) শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র ‘চামেলি মেমসাহেব ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পদ্মশ্রী লাভ করেন ১৯৭৭ সালে। শ্রেষ্ঠ লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে ‘অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশনের পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে, অসম সরকারের শঙ্করদেব পুরস্কার (১৯৮৭), দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৯২), জাপানে এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রুদালি ছবির শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার অর্জন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে। এ ছাড়া পদ্মভূষণ (২০০১), অসমরত্ন (২০০৯), সংগীত নাটক অ্যাকাদেমি পুরস্কার (২০০৯) ও ভারতরত্ন (২০১৯)।

 

শিল্পীর ভাস্কর্য

২০০৯ সালে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের উদ্যোগে গুয়াহাটির দীঘলিপুখুরী (ঐতিহাসিক দিঘি) জিএসবি রোডে একটি স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। আসামের ভাস্কর্যশিল্পী বিরেন সিংহ ফাইবার গ্লাস ও অন্যান্য পদার্থ দ্বারা চমকপ্রদ ‘ড. ভূপেন হাজারিকা ভাস্কর্য’ তৈরি করেন।

 

জন্ম ও মৃত্যু

ভূপেন হাজারিকার জন্ম আসামের সাদিয়ায় ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। ছোটবেলা থেকেই আসামের লোকজ গানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। এই গানগুলো গাইতে পছন্দ করতেন। শিক্ষাজীবনের শুরু আসামের সোনারাম, তেজপুর, ধুবড়ি এবং বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. ভূপেন হাজারিকা কিডনি বৈকল্যসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর ধরাধাম ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে এই গুণী শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর