মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই আশা ভোঁসলে এখন...

সেই আশা ভোঁসলে এখন...

‘আশা ভোঁসলে’ ভারতীয় সংগীত জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম। ৯০ বছর বয়সে এই শিল্পী গানের পাশাপাশি এখন রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

নিজের  রেস্তোরাঁয় এখন ‘মাস্টার শেফ’

ভারতের সেরা সংগীত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম আশা ভোঁসলে। তিনি শুধু ভারতেরই নন, গোটা পৃথিবীর সংগীত অনুরাগীদের আইকন। আশা ভোঁসলে এমন একজন মানুষ, যাঁর কণ্ঠের জাদুতে বুঁদ গোটা দুনিয়ার মানুষ। আশা ভোঁসলের দুর্দান্ত গানের গলা তো সবাই শুনেছে। তিনি যে একজন দুর্দান্ত রাঁধুনী সে কথা জানতেন কি? আশা ভোঁসলে একজন সুগায়িকা হওয়ার পাশাপাশি ভালো রাঁধুনীও। দুবাইয়ে তাঁর নিজের একটি নতুন রেস্টুরেন্ট রয়েছে। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন তিনি। বিগত ২১ বছর ধরে হসপিটালিটি বিজনেস সামলাচ্ছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। তবে শুধু দুবাইয়ই নয়, তাঁর রেস্তোরাঁ রয়েছে ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে। যারা বিদেশের মাটিতে ভারতের খাবারদাবারের আস্বাদ নিতে চান তারা চলে যান ওই রেস্টুরেন্টে। প্রবাসী ভারতীয় এবং বিদেশিদের কাছে খুব জনপ্রিয় আশা ভোঁসলের রেস্তোরাঁ। এখানে ভারতের বিভিন্ন রেসিপি রান্না হয়। কখনো কখনো রান্না করেন আশা ভোঁসলে নিজেও। গত বছরের শেষদিকে দুবাইয়ের রেস্তোরাঁর সুসজ্জিত কিচেন থেকে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেন আশা। সেখানে তাঁকে অ্যাপ্রোণ পরে নিজের হাতে রান্না করতে দেখা যায়। সেই সঙ্গে অতিথি আপ্যায়ন করছেন।  ভিডিওতে তাঁকে দেখা গেছে দুবাইয়ের আশা’স-এ শেফের পোশাক পরে পোলাওজাতীয় কোনো একটি খাবার রান্না করতে করতে গাইছেন ‘আও না গলে লাগ যাও’ গানটি। আবার খুন্তিতে খানিকটা খাবার তুলে এনে ঘ্রাণও যাচাই করছেন। গায়িকার এই অতিথিবৎসল রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে রান্না করার পাশাপাশি রান্নাটা ঠিকঠাক হয়েছে কি না জানার জন্য গন্ধ শুঁকে দেখছেন আশা। এই ভিডিও দেখে আশার ভক্তরা ভালোবাসা উজাড় করে দিচ্ছেন তাঁকে। প্রশংসা করে লিখছেন, ‘গানা আর খানা মারাত্মক কম্বিনেশন, দুটোই মনের খুব কাছের।’ কিংবদন্তি গায়িকাকে ‘মাস্টার শেফ’ বলে প্রশংসাও করছেন অনুরাগীরা। আশা ভোঁসলের দুবাইয়ের এই রেস্তোরাঁ দেখলে চমকে যেতে হয়। আশা’স রেস্তোরাঁয় ঢোকার মুখেই পড়বে সুন্দর করে সাজানো ওয়েটিং এরিয়া। সেখানে রয়েছে বেগুনি রঙের কাউচ, দেয়ালে টাঙানো রয়েছে আশার সাদাকালো ফটো ফ্রেম। মূল রেস্তোরাঁটিতে আরও জাঁকজমক রয়েছে। সেই সঙ্গে রান্নাঘরটাও প্রয়োজনীয় উপকরণে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।

প্রকৃত নাম আশা মঙ্গেশকর

আশা ভোঁসলের প্রকৃত নাম ‘আশা মঙ্গেশকর’। তাঁর মঙ্গেশকর পদবিটি পৈতৃক সূত্রেই পাওয়া। বাবার নাম ছিল দীননাথ মঙ্গেশকর। দীননাথ ছিলেন মারাঠি সংগীত মঞ্চের একজন অভিনেতা ও শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। আশার গাওয়া প্রথম গান হলো মারাঠি ভাষার মাঝা বল (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে ‘চল চল নব বল’। হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে আশার অভিষেক হয় ১৯৪৮ সালে ‘সাবন আয়া’ ছবির গানে প্লেব্যাকের মাধ্যমে। আশা ভোঁসলে ১৯৩৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সঙ্গিল রাজ্যের (বর্তমান মহারাষ্ট্রে অবস্থিত) সঙ্গিল জেলার গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন।

 

যেভাবে ‘আশা ভোঁসলে’ হলেন

আশা তাঁর দিদি লতা মঙ্গেশকরের সেক্রেটারি গণপত রাও ভোঁসলের প্রেমে পড়েন একসময়। সেই গণপত ভোঁসলেকে বিয়ে করেছিলেন আশা মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তারপর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত নিজের নামের পদবি ‘মঙ্গেশকর’ ছেঁটে ফেলে হয়ে যান ‘ভোঁসলে’। মানে স্বামীর পদবি ভোঁসলে গ্রহণ করে হয়ে যান আশা ভোঁসলে।

 

বেশি দিন টেকেনি বিয়ে

বেকার গণপতকে নিয়ে আবার জীবন সংগ্রামে নামেন আশা ভোঁসলে। আশা তখন তিন ছেলেমেয়ের মা। অভাবের তাড়নায় সংসারের বোঝা বইতে না পেরে ছেলেমেয়েসহ আশাকে বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেন গণপত।

 

রাহুল দেবের প্রেমে

১৯৬৬ সাল। প্রখ্যাত সংগীতকার শচীন দেব বর্মণের ছেলে গায়ক রাহুল দেব বর্মণ পঞ্চম প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন তাঁরই অন্ধ ভক্ত রীতা পটেলকে। প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৭১-এ এসে বোঝাপড়ার ভার সামলাতে না পেরে দুইদিকে সরে যান দুজনই। এরপর গানের নেশায় বুঁদ হয়ে রইলেন পঞ্চম। এরপর তাঁর জীবনে এলেন তাঁর বয়স থেকে ছয় বছরের বড় আশা ভোঁসলে। ভালোবাসলেও সে কথা মুখ ফুটে প্রথমে কিছুতেই আশাজিকে জানাতে পারেননি রাহুল। বদলে একের পর এক গান গাইয়েছেন তাঁকে দিয়ে। বেশিক্ষণ কাছে পাওয়ার আশায়। সেই গানে গানেই বোঝাতে চেষ্টা করতেন, আশা তাঁর পরম পাওয়া। আশা আরও একটু সাহসী। তাই পঞ্চমকে আদর করে ডাকা শুরু করেছেন ‘বাবস’ বলে। কিন্তু ভালোবাসার কথা বলতে ভয় ছিল তাঁরও। শেষে একদিন আশাকে দিয়ে গাওয়ালেন রাহুল, ‘কহে দু তুমহে, ইয়া চুপ রহু...’, মানে ‘তুমি কি কিছু বলবে নাকি চুপ করেই থাকবে?’ গান রেকর্ডিংয়ের পর আশা যখন বেরিয়ে আসছেন রেকর্ডিং রুম থেকে তখন রাহুল তাঁকে নরম গলায় বললেন, আর কীভাবে বলে বোঝাতে হবে। লজ্জায় লাল আশা সেদিন কোনো কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে বলেছিলেন, সব বুঝেছেন। আর বলতে হবে না। এরপর ১৯৮০-তে ফের সাতপাক ঘোরেন রাহুল দেব বর্মণ-আশা ভোঁসলে।

 

হারালেন রাহুলকে

নিয়তি বড়ই নির্মম। এবার জীবনের নিমোঘ সত্য ‘মৃত্যু’ আশার দ্বিতীয় সংসার ভেঙে তছনছ করে দিল। রাহুলকে কেড়ে নিল তাঁর জীবন থেকে। ১৪ বছর সুর নিয়ে, গান নিয়ে একসঙ্গে ঘর করার পর ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে পাকাপাকি বাসিন্দা হলেন পঞ্চম।

 

ভোঁসলে পদবি পাল্টাননি আশা

কথায় আছে ‘প্রথম প্রেমের স্মৃতি নাকি কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।’ আশার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল বলে বলতেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা। প্রথম স্বামী গণপতের সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং পরবর্তীতে রাহুল দেব বর্মণকে বিয়ে করলেও প্রথম স্বামীর পদবি ‘ভোঁসলে’ আজ পর্যন্ত ত্যাগ করেননি আশা। এখনো আশা ভোঁসলে হয়েই রইলেন তিনি।

 

যত সম্মাননা

১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আশা ভোঁসলে সাতবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা নেপথ্য গায়িকার পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৭ সালের পর তিনি জানান যে, তাঁর নাম যেন আর ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য গণ্য করা না হয়। ২০০১ সালে তিনি ‘ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’ পান। আশার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো ‘বলিউডের সর্বকালের সেরা কণ্ঠশিল্পী’ নির্বাচিত হওয়া। ২০১৫ সালে ৮১ বছর বয়সী বর্ষীয়ান এই গায়িকা টপকে গেছেন নিজের বড় বোন লতা মঙ্গেশকরকে। ৮৫ বছর বয়সী লতা হয়েছেন দ্বিতীয়। ওই বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা ‘ইস্টার্ন আই’ সেরা ২০ কণ্ঠশিল্পীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। আট দশক ধরে একের পর এক রেকর্ড ভেঙে অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ার গড়েছেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর