বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেব-সুরাইয়ার সেই প্রেম কাহিনি

বলিউডের রোমান্টিক নায়কদের মধ্যে দেব আনন্দ অন্যতম। অগণিত নারীহৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দেব আনন্দের মনে চিরদিনের মতো যিনি দাগ কেটেছিলেন, তিনি হলেন অভিনেত্রী সুরাইয়া। যদিও এই প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি ছিল বিয়োগান্তক। তাঁদের বেদনাবিধুর প্রেমকাহিনির কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

দেব-সুরাইয়ার সেই প্রেম কাহিনি

প্রথম দেখা

দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রথম দেখা হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষদিকে। তখন দেব সবেমাত্র পা রেখেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। অন্যদিকে সুরাইয়া তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। নায়িকা সুরাইয়ার রূপ ও গুণে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হন দেব। তাঁদের পরিচয় পর্বটি ছিল বেশ নাটকীয়। বোম্বে থেকে ট্রেনে পুনা যাচ্ছিলেন দেব। তাঁর সঙ্গে একই কামরায় ওঠেন সুরাইয়া। দেব মুগ্ধ হন তাঁর অসাধারণ রূপ ও কণ্ঠে। পরে কাজের সূত্রে আলাপ জমে ওঠে তাঁদের। চলচ্চিত্রে সংলাপ বলার সময় নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করতেন তাঁরা। অভিনয়ের ছলে ভালোবাসার আলাপন চলত তাঁদের।

 

যেভাবে প্রেমের সূচনা

১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রথম জুটি বাঁধা ছবি ‘বিদ্যা’। ছবিতে ‘কিনারে কিনারে চলে যায়েঙ্গে’ গানের শুটিংয়ের সময় নৌকা উল্টে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন সুরাইয়া। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে বাঁচান দেব আনন্দ। এই ঘটনায় সুরাইয়ার মনের গভীরে গেঁথে যান দেব। এক স্মৃতিকথায় সুরাইয়া বলেন, দেব আনন্দের ব্যক্তিত্বের সাদাসিধে দিকটাই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রাণরক্ষার পর সুরাইয়া বলেছিলেন, ‘তুমি যদি না বাঁচাতে, আজ আমার জীবন শেষ হয়ে যেত।’ শুনে নাকি দেব আনন্দ বলেছিলেন, ‘তোমার জীবন শেষ হলে সেই সঙ্গে আমারটাও শেষ হয়ে যেত।’ এরপর দুজনের সম্পর্ক গাঢ় হতে আর দেরি হয়নি।

 

বাঁধনহারা প্রেম

দীর্ঘদিন লুকিয়ে প্রেম করলেও ১৯৫০ সালে ‘আফসার’ ছবির সেটে অনেকেরই নজরে পড়ে যান তাঁরা। তখন দুজন মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যেতেন কিংবা স্টুডিওর ভিতরেই খুঁজে নিতেন নিরালা কোনো জায়গা। সিনেমার শুটিংয়ে যখন তাঁরা প্রেমের অভিনয় করতেন তখন ইউনিটের সবাই টের পেত তাঁদের ভালোবাসা। এভাবেই চলছিল তাঁদের বাঁধনহারা প্রেম পর্ব।

 

দেব যে কারণে গ্রেগরি পেক

দেব আনন্দকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার ‘গ্রেগরি পেক’। শোনা যায়, প্রেয়সী সুরাইয়ার মন জয় করতেই তিনি গ্রেগরি পেককে অনুসরণ করতেন। কারণ গ্রেগরি পেক ছিলেন সুরাইয়ার প্রিয় অভিনেতা।

 

ধর্মই প্রেমের বাধা

হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেব আনন্দ আর মুসলিম সুরাইয়ার প্রেমের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল ধর্ম। ১৯৪৯ সালে ‘জিৎ’ ছবির শুটিংয়ের সময় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহঅভিনেত্রী দুর্গা খোটে। কিন্তু এক সহপরিচালক এই খবর জানিয়ে দেন সুরাইয়ার বাড়িতে। তাঁর দিদিমা এসে সেট থেকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুরাইয়াকে। সুরাইয়ার পরিবারে তাঁর দিদিমা বাদশাহ বেগম ও মামার মারাত্মক প্রভাব ছিল। কার্যত দোর্দন্ড প্রতাপ দিদিমাই ছিলেন সংসারের শেষ কথা। তিনি কোনোমতেই নাতনির সঙ্গে দেব আনন্দের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। কারণ, সংসারের মূল উপার্জনক্ষম সুরাইয়ার বিয়ে দিতে তাঁরা রাজি ছিলেন না।

 

আবারও বিয়ের উদ্যোগ

১৯৫০ সালে মুক্তি পায় তাঁদের ছবি ‘নীলি’। শুটিং সেটে সুরাইয়াকে আরও একবার বিয়ের প্রস্তাব দেন দেব। পালিয়ে গিয়ে বিয়েতেও কোনো আপত্তি ছিল না তাঁর। কিন্তু সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে রাজি হননি সুরাইয়া। রাগে জ্ঞান হারিয়ে সুরাইয়াকে চড় মেরেছিলেন দেব আনন্দ। বলেছিলেন, ‘সুরাইয়া ভীতু ও কাপুরুষ।’ পরে এই ঘটনার জন্য বারবার ক্ষমা চান অনুতপ্ত দেব আনন্দ। পরের বছর সুরাইয়াকে হিরের আংটি দিয়ে প্রোপোজ করেন দেব আনন্দ। সেটি অনামিকায় পরেও ফেলেন সুরাইয়া। তবে সেই আংটি তাঁর দিদিমার নজর এড়ায়নি। এমনকি, তিনি যখন জানতে চান, সুরাইয়া সত্যি কথা-ই বলেন। ওই আংটি তাঁর হাত থেকে খুলে নিয়ে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেন বাদশাহ বেগম।

 

দেবকে হত্যার হুমকি

দেব আনন্দকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন সুরাইয়ার দিদিমা ও মামা। এরপর সুরাইয়া নিজেকে এই সম্পর্ক থেকে সরিয়ে নেবেন বলে স্থির করেন। তিনি চাননি, তাঁর জন্য দেব আনন্দের কোনো ক্ষতি হোক।

 

লুকিয়ে শেষ দেখা

তবু দেব আনন্দ আসতেন তাঁর প্রেয়সীর সঙ্গে দেখা করতে। সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা করতেন বাড়ির ছাদে। সেখানেই তাঁদের শেষ দেখা হয়েছিল। বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সুরাইয়ার মা। বাড়ির পেছনের পানির পাইপ বেয়ে দেব উঠতেন ছাদে। সন্ধ্যার অন্ধকারে পানির ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন সুরাইয়া। অশ্রু ভেজা চোখে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতেন তাঁরা। এক সন্ধ্যায় চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন তাঁরা একে অপরের কাছ থেকে। শেষ হয়ে গিয়েছিল দুজনের চার বছরের সম্পর্ক। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া দেব আনন্দের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর দাদা চেতন আনন্দ। পরামর্শ দিয়েছিলেন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে অভিনয়ে মনোনিবেশ করতে।

 

দেবের বিয়ে এবং অসুখী

দেব আনন্দ বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৪ সালে। বিয়ে করেন ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ সিনেমায় তাঁর সহঅভিনেত্রী কল্পনা কার্তিককে। কিন্তু এ বিয়েতে তিনি সুখী হতে পারেননি। কারণ দেবের মনজুড়ে শুধুই ছিলেন সুরাইয়া।

 

একাই রয়ে গেলেন সুরাইয়া

 দেবের বিয়ের পর ভগ্নহৃদয়ের সুরাইয়া আশ্রয় খুঁজেছিলেন মায়ের মধ্যে। দেব আনন্দের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর কমিয়ে দেন ছবিতে অভিনয়। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় তার শেষ ছবি ‘রুস্তম সোহরাব’। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন সুরাইয়া। আর চিরসবুজ দেব আনন্দ প্রয়াত হন ২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর।

 

সুরাইয়ার অনুতাপ

দেবকে হারিয়ে চরম নিরাশায় ডুবে যান সুরাইয়া। সুরাইয়া অবিবাহিত ছিলেন সারা জীবন। মা, বাবা, নানির মৃত্যুর পর আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর আত্মীয়রা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান। বোম্বেতে রয়ে যান শুধু সুরাইয়া। ছিলেন খুব নিভৃতচারী। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানে যেতেন না। গানের জগৎও ত্যাগ করেন।

 

 

 

সর্বশেষ খবর