শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নির্মাতা এহতেশামের বর্ণিল ক্যারিয়ার

নির্মাতা এহতেশামের বর্ণিল ক্যারিয়ার

এহতেশামের হাতে সম্মাননা তুলে দিচ্ছেন বলিউড মুঘল দিলীপ কুমার

বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সফল নির্মাতা এহতেশাম। তারকা তৈরির কারিগর নামেও খ্যাত তিনি। এ দেশের প্রথম ব্যবসা-সফল ছবি ‘রাজধানীর বুকে’র নির্মাতাও ছিলেন তিনি। বাংলা ও উর্দু, দুই ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণে দেখিয়ে গেছেন সমান দক্ষতা। এই গুণী চলচ্চিত্রকারের জীবনের সাতসতেরো তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

পারিবারিক জীবন

এহতেশাম (আবু নূর মোহাম্মদ এহতেশামুর রহমান) ১৯২৫ সালের ১২ অক্টোবর ঢাকার বংশালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ ইউসুফ ছিলেন ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক এবং মা মোছাম্মত কানিজ ফাতেমা গৃহিণী। তাঁর ছোট ভাই চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক মুস্তাফিজ। চলচ্চিত্র পরিচালক ই আর খান ছিলেন তাঁর মামা। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান ছিলেন তাঁর মামাতো ভাই। তাঁর ছেলে চলচ্চিত্র পরিচালক মুশতাক। নায়ক নাদিম তাঁর জামাতা। ১৯৪৬ সালে চাচাতো বোন নাজমার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এহতেশাম। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে ঢাকায় চলে আসেন।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ

এহতেশাম প্রথমে ‘সেন্ট গ্রেগরি স্কুল’ ও পরে ‘আরমানিটোলা স্কুলে’ লেখাপড়া করেন। তারপর ভারতে সিনিয়র ক্যামব্রিজ পাস করেন। প্রথম চাকরিজীবনে তিনি জিআইপি রেলওয়েতে ট্রাফিক কন্ট্রোলার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে কিং কমিশনে অফার পেয়ে ব্রিটিশ ভারতের সেনা বহরে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তানের করাচিতে হয়েছিল তার বদলি। ওই দায়িত্বে থাকার সময়ই পাকিস্তানের নির্মাতা আশিক মল্লিকের ‘বাঘী’ সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়ে তাঁর মনে কৌতূহল জন্মায়, সিনেমার চিত্রধারণ কীভাবে হয়? সেখান থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়।

 

চলচ্চিত্রকার হিসেবে যাত্রা

১৯৫০ সালে এহতেশাম প্রথমে প্রদর্শক হিসেবে চলচ্চিত্রের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। লালমনিরহাট রেলওয়ে ইনস্টিটিউট থেকে হল লিজ নিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসা শুরু করেন। তারপর নাটোর ও সান্তাহারে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করে ফেলেন। ১৯৫৬-৫৭-এর দিকে গঠন করেন পরিবেশনা সংস্থা ‘লিও ফিল্মস’। পরে হন পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, কাহিনি, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার। এহতেশাম পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। বিনোদনধর্মী, ব্যবসা-সফল ছবির খ্যাতিমান নির্মাতা এহতেশাম প্রযোজিত ও পরিচালিত অন্য ছবিগুলোর মধ্যে- রাজধানীর বুকে (পরিচালনা ও প্রযোজনা), হারানো দিন (প্রযোজনা), চান্দা (পরিচালনা ও প্রযোজনা), নতুন সুর (পরিচালনা), সাগর (পরিচালনা), তালাশ (পরিচালনা), মালা (প্রযোজনা), চকোরী (পরিচালনা), ছোট সাহেব (প্রযোজনা), চাঁদ আউর চাঁদনী (প্রযোজনা ও পরিচালনা), আনাড়ি (প্রযোজনা), পায়েল (প্রযোজনা), পিচঢালা পথ (প্রযোজনা ও পরিচালনা), দূরদেশ (পরিচালনা), শক্তি (পরিচালনা), চাঁদনী (পরিচালনা), চোখে চোখে (পরিচালনা), চাঁদনী রাতে (পরিচালনা), সৈনিক (পরিচালনা), মৌমাছি (পরিচালনা), পরদেশি বাবু (পরিচালনা ও প্রযোজনা) ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথম ব্যবসা-সফল জনপ্রিয় ছবির পরিচালক এহতেশাম। তাঁর নির্মিত ছবি ‘রাজধানীর বুকে’র ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি তখনকার সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরত (যা এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়)। এরপর পরিচালক এহতেশামের নাম শুনলেই দর্শকরা ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে ভিড় জমাতেন।

 

জনপ্রিয় তারকা গড়ার কারিগর

এহতেশাম যেমন ছিলেন ব্যবসা-সফল জনপ্রিয় ছবির গুণী নির্মাতা, তেমনই ছিলেন জনপ্রিয় তারকা গড়ার কারিগর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি যেসব তারকা উপহার দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন- নায়ক আনিস (খান আতা), রহমান, আজিম, নাদিম, নাঈম। নায়িকা সুমিতা দেবী, চিত্রা সিনহা, শবনম, শাবানা, শাবনাজ, শাবনূর। তাঁর হাত ধরে আরও এসেছেন অভিনেতা সুভাষ দত্ত, আশীষ কুমার লোহ, খান জয়নুল, গোলাম মোস্তাফা, শওকত আকবর, মনজুর হোসেন, এসেছেন সুরকার-সংগীত পরিচালক আলী হোসেন, রবিন ঘোষ, ফেরদৌসী রহমান। চলচ্চিত্রকার হিসেবে আছেন জহির রায়হান, কামাল আহমেদ, আজিজুর রহমান।

 

দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে স্বপ্ন

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি রূপে দাঁড় করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন তিনি।

তিনি চেয়েছিলেন শিল্প ও বাণিজ্য দুটোতেই যেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এগিয়ে যায়। বোম্বের জনপ্রিয় শিল্পীদেরও তিনি যৌথ প্রযোজনার ছবিতে অভিনয়ের জন্য অনুপ্রাণিত করতেন, ফলে রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর, প্রেম চোপড়ার মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয় করে গেছেন।

 

যেভাবে ক্যাপ্টেন উপাধি

এহতেশামের সময়োপযোগী-সঠিক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বের কারণে চলচ্চিত্রের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধি দিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ‘ক্যাপ্টেন এহতেশাম’, যা অন্য কেউ হয়তো আর কোনো দিন হতে পারবেন না। এহতেশাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন দিকপাল, বাণিজ্যিক ছবির কুশলী নির্মাতা। এহতেশাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক অবিস্মরণীয় নাম।

 

শবনম, শাবানা, শাবনূরের নামের গল্প

এহতেশামের হাত ধরে সিনেমায় আসা বেশির ভাগ অভিনেত্রীর নাম ‘শাব’ দিয়ে শুরু। শবনম, শাবানা, শাবনূর, শাবনাজ, এসব নামই এহতেশামের দেওয়া। শাব একটি উর্দু শব্দ, এর অর্থ রাতের আলো। অন্ধকারের মধ্যে আলো কিছুটা রহস্য তৈরি করে। এ জন্যই নির্মাতার শাব শব্দটি ছিল খুব প্রিয়। আর তাই তো আফরোজা সুলতানা রত্না সিনেমায় নাম লিখিয়ে হয়ে যান শাবানা। ঝর্ণা বসাক নাম বদলে হয়ে যান শবনম। একইভাবে পারিবারিক নাম বদলাতে হয়েছে শাবনাজ, শাবনূরকেও।

 

শেষ ইচ্ছা অধরাই রয়ে গেল

এহতেশামের শেষ ইচ্ছা ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া নামের একটি সিনেমা করবেন। পা-ুলিপি লেখাও শেষ হয়েছিল। ২০০২ সালে প্রায় সবকিছুই গুছিয়ে এনেছিলেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় দ্রুত ছবি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে নিজের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রেখেই এহতেশাম চলে যান না ফেরার দেশে। তাই শেষ ইচ্ছা তাঁর অধরাই রয়ে গেল।

সর্বশেষ খবর