রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের অনবদ্য এক কারিগর

মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের অনবদ্য এক কারিগর

চাষী নজরুল ইসলাম

দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ করেছেন তিনি। সাহিত্যেরও অনুরাগী ছিলেন এই নির্মাতা। মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র সবচেয়ে বেশি নির্মাণ করেন এই বরেণ্য চলচ্চিত্রকার।  ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি না-ফেরার দেশে চলে যান তিনি। প্রয়াত চাষী নজরুলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর কর্মজীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

 

মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য যাঁর সিনেমার হাতিয়ার

১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ করে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হন চাষী নজরুল ইসলাম। চাষী নজরুলের নির্মাণ তালিকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিনেমা মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্যনির্ভর। তাঁর ৩৫টি সিনেমার ১১টি সাহিত্যনির্ভর। ছয়টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। এ ছাড়া জীবনীভিত্তিক সিনেমা আছে দুটি- ‘হাছন রাজা’ ও ‘শিল্পী’।

 

‘ওরা ১১ জন’-এর অন্তরালের যত খবর

সদ্য যুদ্ধফেরত দুই তরুণ খসরু ও মাসুদ পারভেজ চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়টিকে সবার কাছে তুলে ধরতে। একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর চাষী নজরুল নামের ছেলেটার মাথায়, ভাগ্যদেবীর ইচ্ছায় এই তিনজনের দেখা হলো। এভাবেই শুরু হয় ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার কাজ। চার মাসের কঠোর পরিশ্রম শেষে ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা। ওরা ১১ জন সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সিনেমা থেকে আলাদা। কারণ এই সিনেমায় যে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই ১১ জন হলেন- খসরু, মুরাদ, নান্টু, আলতাফ, আবু, হেলাল, আতা, বেবি, অলিন, ফিরোজ ও মঞ্জু। ছবিটির সংলাপ লিখেছেন এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি রাজাকার চরিত্রে ছবিটিতে অভিনয়ও করেছেন। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত অস্ত্র-গোলা-বারুদ সবই ছিল সত্যিকারের- জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মস ও অ্যামুনেশন সরবরাহ করা হয়। জয়দেবপুর সেনানিবাসের সেনাসদস্যরাও অভিনয় করেছেন সিনেমাটিতে। সাহস করে সত্যিকারের অস্ত্র তো ব্যবহার করলেন, কিন্তু এর জন্য ঝামেলা কম পোহাতে হয়নি। একটি দৃশ্য ছিল এমন- একটি মেয়েকে পাকিস্তানি হানাদাররা তাড়া করবে এবং গুলি ছুড়তে থাকবে কিন্তু মেয়েটির গায়ে কোনো গুলি লাগবে না। যেহেতু গুলি ছিল আসল, তাই গুলি গায়ে লেগে আহত বা নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। চিত্রগ্রাহক আবদুস সামাদ ‘আমি সিনেমার অংশ হতে এসেছি, মানুষের মৃত্যুর অংশ হতে আসিনি’ বলে বেঁকে বসলেন। শেষ পর্যন্ত খসরু গুলি ছোড়ার দায়িত্ব নিলেন। দৃশ্যটি ধারণ শুরু হলো। মেয়েটি দৌড়াচ্ছে আর খসরু একে একে ৩০টি গুলি ছুড়লেন। গুলি মেয়েটির খুব কাছ দিয়ে চলে গেল, কয়েকটা জামাও স্পর্শ করল কিন্তু একটাও শরীরে লাগল না। সফলভাবে এই কঠিন দৃশ্য ধারণ শেষে সবাই আনন্দে খসরুকে জড়িয়ে ধরলেন। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য দেই, এই সিনেমায় সত্যিকারের পাকিস্তানি সৈন্যরাও অভিনয় করেছেন। দৃশ্যটি ছিল ধরা পড়ে যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যকে মেরে ফেলার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আটকে পড়া দুই পাকিস্তানি সৈন্য তখন চলচ্চিত্রটির ইউনিটের কাছে বন্দি ছিল। তাদের তখনো বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। ওই দুই  সৈন্যকে দিয়েই দৃশ্যটিতে অভিনয় করানো হয়। এরপর তাদের সেনানিবাস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ‘ওরা ১১ জন’-এর নামকরণ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ছবির শুরুতে ছয়টি গোলার শব্দ শোনা যায়। নির্মাতা বলেছিলেন এই ছয়টি শব্দ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতীকী শব্দ। ছবিটি প্রযোজনা করেন মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা।

 

‘সংগ্রাম’ ছবিতে বঙ্গবন্ধু

‘সংগ্রাম’ সিনেমায় কিছুক্ষণের জন্য ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সিনেমাটি নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। এই ছবির চিত্রনাট্যের শেষদিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্যালুট করছে। এই দৃশ্য কীভাবে ধারণ করা যায়, সে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান পরিচালক চাষী নজরুল। এক প্রকার দুঃসাহস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন খসরু। প্রথমে না করলেও পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নানকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে অভিনয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুকে রাজি করান খসরু। ‘সংগ্রাম’ মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।

 

নান্দনিক কাজ ‘দেবদাস’

চাষী নজরুলের আরেক নান্দনিক কাজ ‘দেবদাস’। ১৯৮২ সালে বুলবুল আহমেদ, কবরী ও আনোয়ারাকে নিয়ে তিনি যখন ছবিটি নির্মাণ করেন তখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন।

কারণ শরৎ সাহিত্য নিয়ে ভারতে ততদিনে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। তবে

 

তিনি বেশ সফল হন। শরৎ সাহিত্য নিয়ে এটি দেশের দ্বিতীয় নির্মাণ হলেও এখন পর্যন্ত দর্শক পছন্দের শীর্ষে রয়েছে। দেবদাসের ভূমিকায় বুলবুল আহমেদ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, আজও তিনি ‘বাংলার দেবদাস’ হিসেবে খ্যাত।

‘পার্বতী’র ভূমিকায় কবরীর অভিনয়ও ছিল অনন্য। ছবিটিকে রিমেকের অজুহাত তুলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ড তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল।

 

সৃজনশীল সেরা কাজ

শুভদা : ১৯৮৬ সালে শরৎ সাহিত্য থেকে তাঁর নির্মিত ‘শুভদা’ ১৩টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। যেটি ছিল বিরল এক রেকর্ড। হাঙর নদী গ্রেনেড :  সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে ছবিটি নির্মাণ করেন সরকারি অনুদান নিয়ে। এ ছবির প্রধান চরিত্রে সুচরিতার অভিনয় এখনো সর্বমহলে সমাদৃত। এ ছবিটিও তিনটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। শাস্তি : চাষী নজরুল রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে নির্মাণ করেন ‘শাস্তি’। ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি এ দেশে রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে বানানো প্রথম ছবি। ছবিটি দুটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।

 

নাম রাখেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক

চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মা-বাবার জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর বাবা মোসলেহ উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন ভারতের বিহারে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার।  চাষীর নাম রেখেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করতেন চাষীর মামা চাষী ইমাম উদ্দিন। সেই সূত্রেই এক দিন ফজলুল হককে একটা নাম দিতে বলা হলে তিনি চাষী ইমাম উদ্দিনের ‘চাষী’ আর কাজী নজরুল ইসলামের ‘নজরুল ইসলাম’ মিলিয়ে নাম দেন ‘চাষী নজরুল ইসলাম’।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

১৯৫৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের বড় ছেলে হিসেবে এজি অফিসের পোস্ট-শর্টার হিসেবে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চাকরি করেছেন চাষী নজরুল ইসলাম। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে ফতেহ লোহানীর প্রধান সহকারী আউয়াল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। একই সঙ্গে আলী মনসুর সাহেবের কৃষ্টি সংঘের সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেন। ছবির প্রতি তাঁর ভালো লাগার কথা জেনে খালাতো বোনের স্বামী সৈয়দ আওয়াল এক দিন চাষীকে পরিচয় করিয়ে দেন পরিচালক-অভিনেতা ফতেহ লোহানীর সঙ্গে। তখন ‘আছিয়া’ ছবির কাজ চলছিল। এতে স্বল্প উপস্থিতির একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চাষীকে নেওয়া হয়। কিন্তু পরদিন তাঁকে দেওয়া হয় সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব। ১৯৬১ সালের জুন মাসে ক্যামেরার পেছনে কাজ শুরু করেন চাষী। ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে   চাষী নজরুল ইসলামও মুক্তিযুদ্ধে যোগ   দেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১   জন’ পরিচালনা করেন তিনি। পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বেতার ও    টেলিভিশনে সান্ধ্যকালীন অভিনয় চালিয়ে  যান তিনি।

 

যত সম্মাননা

১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ আর ১৯৯৭ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০৪ সালে একুশে পদক। অন্যান্য পুরস্কার- ‘সংগ্রাম’ ছবির জন্য বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৪), শেরেবাংলা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৮), স্যার জগদীশচন্দ্র বসু স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হান স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হান আজীবন সম্মাননা, আন্তর্জাতিক কালাকার পুরস্কার (২০০৫) প্রভৃতি।

সর্বশেষ খবর