শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

জীবন গল্পের এক শুদ্ধ নির্মাতা

জীবন গল্পের এক শুদ্ধ নির্মাতা

জহির রায়হান

স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ জহির রায়হান। মাত্র ৩৭ বছর জীবনের পরিধি ছিল তাঁর।  এই ক্ষুদ্র জীবনে দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে দুর্দান্ত প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। এই কিংবদন্তিকে নিয়ে লিখেছেন- আলউদ্দীন মাজিদ

 

রাজনীতিতে

১৯৪৯ সালে ফেনীর সোনাগাজীর আমিরাবাদ স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ মাত্র ১৪ বছর বয়সে লিখলেন ‘ওদের জানিয়ে দাও’ নামের একটি কবিতা। মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ থেকে জহির রায়হান, এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মণি সিংহ। তিনি তখন ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা কলেজে পড়ছেন। বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের সুবাদে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যেক কর্মীর পার্টির দেওয়া একটি নাম থাকত। মোহাম্মদ জহিরুল্লাহর পার্টি নাম রায়হান রেখেছিলেন মণি সিংহ। তারপর থেকে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ দিনে দিনে পরিচিত হয়ে উঠলেন জহির রায়হান নামেই। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে যে ১০ জনের দলটি সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া জহির রায়হান। এর আগে কলকাতার বিখ্যাত মিত্র ইনস্টিটিউটে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের প্রভাবে প্রথম রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসা মোহাম্মদ জহিরুল্লাহর। তারপর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন ‘স্বাধীনতা পত্রিকা’। তাঁর বাবা মাওলানা হাবিবুল্লাহ ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক।

 

সাংবাদিকতায়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন জহির রায়হান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়ই সাংবাদিক হিসেবে যুগের আলো পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আরও দুটি পত্রিকায় কাজ করেছিলেন জহির রায়হান। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়ই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ।

চলচ্চিত্রে

চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের অভিষেক হয় ১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন এ জে কারদার। পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় ১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। পরের বছর জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন সোনার কাজল। তবে জহির রায়হান মূল আলোচনায় আসেন তারও এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছিল এটি। জহির রায়হান পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা। জহির রায়হানের হাত ধরেই পাকিস্তানের চলচ্চিত্র রঙিন চলচ্চিত্রের জগতে প্রবেশ করেছিল। ১৯৬৪ সালে তাঁর নির্মিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। এরপর একাধারে জীবন থেকে নেয়া, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা, টাকা আনা পাই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক ও তথ্যচিত্র মিলিয়ে তিনি সর্বমোট ১২টি চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। তাঁর নির্মিত বেহুলা চলচ্চিত্র দিয়ে নায়করাজ ‘রাজ্জাক’ বড় পর্দায় বেশ জনপ্রিয় হন।

 

সেই ‘জীবন থেকে নেয়া’

১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। এটি জহির রায়হানের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলে বিবেচিত। সামাজিক এই চলচ্চিত্রে তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম চিত্রায়িত হয়েছিল। এখন যা আমাদের জাতীয় সংগীত। সে বছরই তিনি নির্মাণ শুরু করেছিলেন তাঁর ‘লেট দেয়ার বই লাইট’ চলচ্চিত্রের। এই চলচ্চিত্রটি ছিল চিত্রনাট্য ছাড়া। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য থেকে সংলাপ সবই ছিল জহির রায়হানের উপস্থিত মেধায় রচিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।

কলকাতায় তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাদের মতো নির্মাতারা। চলচ্চিত্রটি দেখার পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘এ এক অনন্য প্রতিভা, চলচ্চিত্রে এক নতুন যাত্রার সূচনা হলো। এক দুর্দান্ত প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের মাইলফলক।’ তখন অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন জহির রায়হান। তারপরও তাঁর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে যত অর্থ এসেছিল সব অকাতরে মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেছিলেন।

 

স্টপ জেনোসাইড

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান চলে যান ভারতের কলকাতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত স্টপ জেনোসাইড তথ্যচিত্র তৈরির কাজ। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে তাঁর নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’কে। যার প্রতিটি সেকেন্ডে মিশে আছে একটি জাতির চিহ্ন। একটি জাতির অসীম ত্যাগের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকালসহ বহুকিছু এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা ধরেছিলেন জহির রায়হান। স্টপ জেনোসাইডের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে। প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি  সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে ‘স্টপ জেনোসাইড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধে জহির রায়হানের প্রভাব এত বিস্তৃত যে, হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবে না। স্টপ জেনোসাইড থেকে শরণার্থী ক্যাম্প, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে মিটিং, সভা-সমাবেশে জনমত গঠন করেছিলেন।

 

উপন্যাস রচনা

১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। এই উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন জহির রায়হান। ১৯৬৯ সালে বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’। একই বছর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আরেক বিখ্যাত উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’।

 

অন্তর্ধান

 দেশ স্বাধীনের পর ভারত থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন জহির রায়হান। তাঁর বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখোঁজ শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ হন। বিজয়ের প্রাক্কালে তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে তুলে নিয়ে যায় আল-বদর বাহিনী। দেশে ফেরার পর থেকেই ভাইয়ের সন্ধান করতে থাকেন জহির রায়হান। ৩০ জানুয়ারি এক ফোন পেয়ে মিরপুরে ভাইকে খুঁজতে যান জহির রায়হান। তাঁর মরিস মাইনর গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেলেও জহির রায়হানের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর জুলফিকার আলী মানিকের প্রতিবেদন ‘নিখোঁজ নন, গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান’ প্রকাশিত হয়। সে বছর সাপ্তাহিক ২০০০-এ পুত্র অনল রায়হান ‘বাবার অস্থির সন্ধানে’ নামে একটি প্রতিবেদন লিখেন। সমাধান হয় জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যের। জানা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই প্রবাদপুরুষ। মাত্র ৩৭ বছর জীবনের পরিধি ছিল জহির রায়হানের। এই ক্ষুদ্র জীবনে দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে দোর্দন্ড প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনেই এই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। কেবল সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নয়, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি গণআন্দোলনে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। তা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৬-র ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হোক কিংবা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রভাগের  সৈনিক। এই ক্ষুদ্র জীবনে একজন মানুষ কতটা দিতে পারেন, জহির রায়হান যেন ছিলেন তার সীমারেখা। যার জীবন ছিল অবিস্মরণীয় কীর্তিতে ভরা।

 

সম্মাননা

বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাঁকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

সর্বশেষ খবর