বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিরসবুজ গানের পাখি ফেরদৌসী রহমান

চিরসবুজ গানের পাখি ফেরদৌসী রহমান

প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসী রহমান। যাঁকে বলা হয় চিরসবুজ গানের পাখি। প্রজন্মের পর প্রজন্মের সংগীত শিক্ষক হিসেবে যিনি সবার কাছে  এক মুগ্ধতার নাম। কণ্ঠে কিংবা চেহারায় আগে যেমনটি ছিলেন এখনো ঠিক তেমনটিই রয়েছেন। এই প্রিয় ব্যক্তিত্বের জীবনের নানা জানা-অজানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

‘এসো গান শিখি’র সেই খালামণি

বিটিভির জনপ্রিয় শিশুতোষ অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’ দিয়ে সবার কাছে ‘খালামণি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ফেরদৌসী রহমান। সেই চিরচেনা মিষ্টি হাসি! এ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের শৈশবস্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শিক্ষামূলক শিশুতোষ অনুষ্ঠানটির সঙ্গে। পাপেট মিঠু-মন্টি, গানের খালামণি-কত কি-ই না এই একটি অনুষ্ঠান থেকে পেয়েছে দর্শকরা! দীর্ঘ সময় ধরে পাক্ষিকভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়ে আসছে ‘এসো গান শিখি’। পুরনো সে চরিত্রগুলোই নতুন সময়ে নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। মাঝে কিছু সময় প্রচার বিরতিতে ছিল। ‘গানের খালামণি’র সঙ্গে থাকে পাপেট চরিত্র মিঠু ও মন্টি।

 

৮২ বছরের অদম্য কিশোরী

এ বছরের ২৮ জুন তাঁর জন্মদিন ছিল। ৮২ তে পা দিয়েছেন তিনি। এখনো ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান নিয়মিত করছেন। মাসে চারবার এই অনুষ্ঠান বিটিভিতে প্রচার হয়। শরীর কিছুটা খারাপ হলেও, এখনো তিনি এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিংয়ে অংশ নিয়ে থাকেন বেশ আগ্রহ নিয়েই। এর বাইরে তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাসউদ্দীন সংগীত একাডেমির পেছনে সময় দিচ্ছেন। ফলে আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া গানগুলো এখন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও আবারও গাইতে শুরু করেছেন। এটিকে আরও বড় করার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।

 

ঘরে বসে গান শোনেন

খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বা জরুরি কাজ না থাকলে ঘরের বাইরে বের হন না তিনি। ঘরে বসে যাদের গান ভালো লাগে মাঝে মাঝে তাদের গান শুনে থাকেন। তাদের কণ্ঠে তিনি তাঁর গাওয়া গান শুনতে বেশি ভালোবাসেন।

 

আত্মজীবনী লিখবেন

বই বের করার ইচ্ছা রয়েছে ফেরদৌসী রহমানের। কোচবিহার আর বলরামপুরে ফেলে আসা শৈশবের গল্প নিয়ে লিখবেন আত্মজীবনী। তিনি বলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমানোর গল্প। বাবা আব্বাসউদ্দীনের কোলে বসে গান শোনার গল্প। গান শোনা আর গান গাওয়া শুরু করার গল্প। টিভি-রেডিও, দেশ-বিদেশের কত ঘটনাই তো আছে এই ছোট্ট জীবনে। আদ্যোপান্ত জীবনটা তুলে আনার ইচ্ছা।’

 

পাঁচ দশক ধরে তাঁর সংগীত জগতে

পাঁচ দশক ধরে তাঁর সংগীত জগতে পদচারণা। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক এবং প্লে-ব্যাক- সব ধরনের গানই তিনি করেছেন। 

 

অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম

বাংলা গানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম বলা হয় তাঁকে। বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার অনেক কিছুর শুরু তাঁর হাতে। ১৯৪৮ সালে প্রথম রেডিওতে গান করেন ‘খেলাঘর’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাড়ে সাত বছর। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচএমভি থেকে। ১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ নামের চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। ১৯৬০ সালে ফেরদৌসী রহমান ইউনেস্কো ফেলোশিপ পেয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ৬ মাসের সংগীতের ওপর স্টাফ নোটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনিই গান করেন। ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেম’-গানটি ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গান। এটা একটা বিরল রেকর্ডও বটে। প্রথম কোনো মহিলা সংগীত পরিচালক হিসেবে রবীণ ঘোষের সঙ্গে ‘রাজধানীর বুকে’ নামক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন তিনি। বিটিভিতে বাচ্চাদের হাতেকলমে গান শেখার আসর ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান শুরু তাঁর হাত দিয়েই। অন্যদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে সাংস্কৃতিক টিম দেশের বাইরে যায়, তার নেতৃত্বও দেন তিনি।

 

একধারায় আটকে থাকেননি

প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসী রহমান। পিতা বিখ্যাত হয়েছিলেন পল্লীগীতি গেয়ে। তিনি বেছে বেছে গান করতেন। ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও তিনি চেষ্টা করতেন ভালোটা-সেরাটা দিতে। ফেরদৌসী রহমান পল্লীগীতি ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান ও চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাকসহ সব ধরনের গানই করেছেন। বাংলা ছাড়া তিনি উর্দু, ফারসি, আরবি, চীনা, জাপানি, রুশ, জার্মানসহ আরও বেশ কিছু ভাষায় গান গেয়েছেন। সংগীত পরিচালনাও করেছেন।

 

তাঁর রেকর্ড

‘৬০ ও ৭০-এর দশকের বহু চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্লে-ব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। তিনটি লং-প্লেসহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তাঁর। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে তাঁর। তিনি ১৯৫৯ সালে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব গান করেছেন তাঁর সব আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে।

 

যেসব গান মন টানে

তাঁর গাওয়া গানের মধ্যে রয়েছে- ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘মনে যে লাগে এত রঙ’, ‘নিশি জাগা চাঁদ’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি’, ‘হার কালা করলাম রে’, ‘গহিন গাঙের নাইয়া’।

সর্বশেষ খবর