বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই আলেয়া এখন ...

সেই আলেয়া এখন ...

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে আলেয়া চরিত্রে আনোয়ারা

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি অভিনেত্রী আনোয়ারা। যিনি ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রে ঐতিহাসিক ‘আলেয়া’ চরিত্রে দক্ষ অভিনয় করে ঢাকার চলচ্চিত্রে নিজের শক্ত ভিত তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি এখন কেমন আছেন।  সেই কথা এবং তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের নানাদিক তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সিরাজউদ্দৌলার আলেয়ায় সফলতা...

‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা, আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা’- কাজী নজরুল ইসলামের এই বিখ্যাত গানের প্রতিটি মুহূর্ত বিমূর্ত হয়ে উঠেছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় আলেয়ার অনুরাগে। খান আতার এই ঐতিহাসিক সিনেমায় সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে বাইজি ‘আলেয়া’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক-খ্যাতি লাভ করেছিলেন তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের একেবারেই নবীন এক মুখ। আলেয়া চরিত্রটি করার আগে সেভাবে পরিচিত ছিলেন না আনোয়ারা। ভাগ্যদেবী যেন তাঁর প্রতি সুপ্রসন্নই ছিলেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এমন একটি ঐতিহাসিক চরিত্র পেয়ে নিজের সবটুকু শ্রম ও মেধা তাতে যেন ঢেলে দিলেন তিনি। হয়ে ওঠলেন কালজয়ী চরিত্রের দক্ষ আলেয়া। সেই ‘আলেয়া’ দিয়ে যে জয়যাত্রা করেছিলেন তাঁর পূর্ণতা ঘটেছে একে একে দেবদাসের ‘চন্দ্রমুখী’ থেকে শরৎচন্দ্রের ‘শুভদা’য়। আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত সিনেমা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’তে ‘ময়না বু’ চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন। গোলাপীর পাশাপাশি ‘ময়না বু’ চরিত্রটি হয়ে উঠেছিল নারী সংগ্রামের প্রতীক। এই চরিত্রে অভিনয় করেই প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।

 

ভালো নেই এখন

২০২১ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ব্যক্তিজীবনে ভীষণ একাকিত্বে ভুগছেন চলচ্চিত্রের ‘দুঃখিনী মা’ অভিনেত্রী আনোয়ারা বেগম। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর মারা যান তাঁর স্বামী মহিতুল ইসলাম। এরপর থেকে বাসায় একাই থাকতেন আনোয়ারা। ওই বছরই একমাত্র মেয়ে অভিনেত্রী রুমানা মুক্তি মাকে নিজের বাসায় নিয়ে আনেন। কিন্তু বিধিবাম ২০২২ সালের ১১ মার্চ রাতে আনোয়ারার ব্রেন স্ট্রোক হয়। এরপর কিছুটা সেরে ওঠলেও আগের মতো আর স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেননি তিনি। চোখে কম দেখা, স্মৃতিশক্তি অনেকটা হ্রাস পাওয়াসহ নানা শারীরিক সমস্যা এই প্রখ্যাত প্রাণচঞ্চল অভিনেত্রীকে জীবনমঞ্চে স্থবির করে দিয়েছে। মেয়ে মুক্তি ও মুক্তির স্বামী সার্বক্ষণিক তাঁর দেখাশোনা করেন। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে নিয়ে যান। শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে মাকে দূরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে এমন একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রীর খোঁজখবর তেমন নেন না তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল চলচ্চিত্র জগৎ ও এই জগতের সতীর্থরা।

 

আমজাদ হোসেনের ছবিতেই বেশি সফল

অভিনেত্রী আনোয়ারাকে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করেছিলেন আমজাদ হোসেন। তাঁর  নির্মিত নয়ন মণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, জন্ম থেকে জ্বলছি, ভাত দে, দুই পয়সার আলতায় অনবদ্য অভিনয় তারই প্রমাণ। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির জন্য সর্বপ্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে ময়না বু চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অভিনব সক্ষমতা দেখিয়েছেন।  ‘ভাত দে’ ছবিতে ভাতের ক্ষুধার জ্বালায় মর্মান্তিক এক বাস্তব চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন এবং জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন আনোয়ারা। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবির ‘বাবা বলে গেল আর কোনোদিন গান করো না’ গানে শিশুশিল্পীর সঙ্গে তিনি অসাধারণ ছিলেন।

 

জাতীয় সম্মাননা

চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য একবার সেরা অভিনেত্রীসহ আটবার সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলো হলো- গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সুন্দরী (১৯৭৯), সখিনার যুদ্ধ (১৯৮৪), শুভদা (১৯৮৬), মরণের পরে (১৯৯০), রাধাকৃষ্ণ (১৯৯২), বাংলার বধূ (১৯৯৩), অন্তরে অন্তরে (১৯৯৪)। এরপর ২০২০ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি লাভ করেন আজীবন সম্মাননা।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

১৪-১৫ বছর বয়সে চলচ্চিত্রে আসেন আনোয়ারা। তাঁর বাবা জামাল উদ্দিনের ইচ্ছা ছিল, তিনি যেন অভিনেত্রী হন। ১৯৬১ সালে অভিনেতা আজিম তাঁকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। ফজলুল হকের ‘আজান’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। মুক্তি দেওয়ার সময় চলচ্চিত্রের নাম পরিবর্তন করে ‘উত্তরণ’ রাখা হয়। তবে ‘উত্তরণ’ চলচ্চিত্রটি আগে মুক্তি পায়নি। তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘নাচঘর’। আবদুল জব্বার খান পরিচালক ছিলেন। শুরুতে তিনি ছিলেন নৃত্যশিল্পী। তবে নায়িকা হিসেবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ১৯৬৭ সালে উর্দু ছবি ‘বালা’তে। অভিনেত্রী হিসেবে আনোয়ারার টার্নিং পয়েন্ট একই বছর মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’। নিজের অভিনয় জীবন শুরুর গল্প এভাবে বলেছিলেন আনোয়ারা- ‘চলচ্চিত্রে অভিনয় করব। এ ধরনের ভাবনা কখনো ছিল না। আমি অভিনয় থেকে নাচকে বেশি ভালোবাসতাম। ছোটবেলায় আমাকে যখন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়, তখন স্কুল ফাঁকি দিতে লাগলাম। কারণ তিনি দেখলেন নাচের প্রতি আমার অন্যরকম ভালোবাসা আছে। তখন বাবা আমাকে হারমোনিয়াম, তবলা কিনে দিলেন। একজন শিল্পীর কিন্তু অভিনয়ের তৃষ্ণা কখনো মিটে না। সেটা জাত শিল্পী হলে থেকেই যায়।’

 

পদকটা বুকে জড়িয়ে ধরলেন

২০২২ সালে আনোয়ারাকে দেওয়া ২০২০ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা। তখন তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী বলে তাঁর মেয়ে মুক্তি পদকটি নিয়ে আসেন। মুক্তি বলেন, ‘পদকটা হাতে নেওয়ার পর মা প্রধানমন্ত্রীর কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। আমি বললাম, ‘আম্মু উনি তোমার কথা বলেছেন’। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি আমার কথা কী বলেছেন? বললাম, ‘তোমার সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন’। শুনে মা খুব খুশি হয়েছেন। বললেন, দেখছ সবাই আমাকে কত ভালোবাসে।”

সর্বশেষ খবর