শিরোনাম
শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নীল দরিয়া পাড়ি দেয়া সেই মিয়া ভাই

নীল দরিয়া পাড়ি দেয়া সেই মিয়া ভাই

‘রেজিস্ট্রি করা চিঠি আইবো, পিওন আইসা ডাক দিবো, সেই চিঠিখান পড়তে হইবো আন্ধার কবরে, ফুরুৎ কইরা উইরা যাইবো প্রাণ পাখিরে’... একটি চলচ্চিত্রে এ গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সবার প্রিয় মিয়া ভাই ফারুক। এ গানটি সত্যি হয়ে গেল তাঁর জীবনে... গত ১৫ মে রঙিন দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন আন্ধার কবরে।  আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁরই জীবনের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সেই আকুতি

‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে দে ছাড়িয়া, বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে, কান্দে রইয়া রইয়া।’... অভিনেতা ফারুক ভাইয়ের এ আকুতি নীল দরিয়া ঠিকই রেখেছে, ছেড়েও দিয়েছে তাঁকে, কিন্তু পৃথিবীর এ নীল দরিয়া যে বড়ই নিষ্ঠুর। কারণ তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তবে এ ধরাধামে থাকতে দেওয়া হয়নি, পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পরপারে...এ বিদায় চিরদিনের, বড়ই কষ্টের। এ দেশের মানুষ তাঁর প্রিয় মিয়া ভাইকে আর কখনোই দেখবে না, এ দুঃখ কোনো দিন ভোলার নয়। বেশকিছু বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে অবশেষে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ফারুক ভাই হেরে গেলেন... ক্লান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন এখন প্রিয় এ মানুষটি।

 

জীবন সংসার

ফারুক নামে পরিচিত আকবর হোসেন পাঠান দুলু ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আজগার হোসেন পাঠান। তাঁর শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে পুরান ঢাকায়। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ঢাকাই সিনেমায় তাঁর অভিষেক হয়। এরপর ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সুজন সখী’, ‘নয়নমনি’, ‘সারেং বৌ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সাহেব’, ‘আলোর মিছিল’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘মিয়া ভাই’সহ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ফারুক ১৯৭৫ সালে ‘লাঠিয়াল’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৮৭ সালে মিয়া ভাই চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে মিয়া ভাই হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০১৯ সালে কলকাতার সম্মানজনক ১৮তম টেলিসিনে অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। প্রায় পাঁচ দশক ঢালিউডে অবদান রেখেছেন অভিনেতা ফারুক। অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৭ আসনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রে গ্রামীণ চরিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক মিয়া ভাই নামে পরিচিত অভিনেতার নাম আকবর হোসেন পাঠান ফারুক।

 

রাজনীতি

ফারুক স্কুলজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময়ে তাঁর নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ফারুক ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

 

শেষ জন্মদিনে দেশবাসীর সামনে

জীবিত অবস্থায় ঢাকাই ছবির এ অভিনেতার শেষ জন্মদিন ছিল গত বছরের ১৮ আগস্ট। ২০২২ সালে নিজের জীবনের বিশেষ দিনটিকে ঘিরে একদিন আগে ১৭ আগস্ট একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন এ অভিনেতা। কে জানত এ ভিডিও বার্তাই হবে জন্মদিন উপলক্ষে অভিনেতার শেষ ভিডিও বার্তা। দেশের একটি টিভি চ্যানেলকে পাঠানো সেই ভিডিওতে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন ফারুক। তখন বরেণ্য এ অভিনেতা বলেন, ‘আমার জন্মদিনকে সামনে রেখে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানাই। সবার কাছে আমার অনুরোধ, গুজবে কান দেবেন না। আমি আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ইনশাআল্লাহ, আমি খুব শিগগির দেশে ফিরব।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ফারুকের কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। সে জড়ানো কণ্ঠে দোয়া চেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের ভালোবাসা ফারুক কোনো দিন ভুলবে না। দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে আমি দোয়া চাই, যেন খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসতে পারি।’ ভিডিও বার্তায় ফারুক জাতীয় স্লোগানও দেন, ‘জয় বাংলা জয় বপ্রন্ধু’। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এ নায়ক।

 

অসুস্থতা ও চলে যাওয়া

২০১২ সালের জুলাইয়ে নায়ক ফারুক এক মাস ধরে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফারুক দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগে ভুগছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট সিঙ্গাপুরে যান ও সেখানকার মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে ভর্তি হন। চিকিৎসা শেষে ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট আবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ খিঁচুনি হওয়ার পরে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। ১৮ মার্চ অবস্থার উন্নতি হলেও ২১ মার্চ আবার অচেতন হলে আইসিইউতে নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করা মিয়া ভাই ফারুক অবশেষে চলতি বছরের ১৫ মে মৃত্যুর কাছে হার মানেন।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

 

শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। বলিষ্ঠ অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন। ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবির এ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। আর এ গানটি শুনলেই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ফারুকের ছবি ভেসে ওঠে। এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। চলচ্চিত্রে আসার কারণ হিসেবে এ অভিনেতা বলেছিলেন, ছাত্রলীগ করার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমার বিরুদ্ধে ৩৭টি হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে। এসব মামলা থেকে বাঁচতে বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে চলচ্চিত্রে আসি।

 

যেভাবে আকবর পাঠান থেকে ‘ফারুক’

পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ফারুক নামটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোশাকি নাম হিসেবে। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর এবং ফারুক নামে নিজের একজন বন্ধু মিলে তাঁকে দিয়েছিলেন এ নাম। ছাত্র জীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লায় নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক এইচ আকবর ছিলেন ফারুকের ঘনিষ্ঠজন। সেই সুবাদে এইচ আকবর তাঁকে চলচ্চিত্রের অভিনয়ে নিয়ে আসেন। এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে।

 

প্রথম ছবি কবরীর সঙ্গে, পারিশ্রমিক ৫০০

ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমার জন্য কত পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি? ২০১৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক অডিও সাক্ষাৎকারে সেটা জানিয়েছিলেন অভিনেতা নিজেই। ফারুকের প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’।  ‘১৯৬৮ সালে ছবিটির শুটিং শুরু হয় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৭১-এ। ছবিতে তাঁর সহকর্মী ছিলেন কবরী, বলা যায় ফারুকের সিনেমা-জীবন শুরুই হয় কবরীর সঙ্গে।’ ছবিতে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৫০০ টাকা।

 

বেড়ে ওঠা

বাবা ছিলেন চিকিৎসক। জন্ম পুরান ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। বাবার নাম আলহাজ ডা. আজগার হোসেন পাঠান। ফারুক ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন।  ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অংশগ্রহণে কোনো রক্তচক্ষু তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধজাহাজ চালানোর স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলায়। নিজের আদর্শ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সর্বশেষ খবর