মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়...

যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়...

কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রাখার অসাধারণ এক জাদু ছিল শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে। দেশাত্মবোধক, আধুনিক কিংবা চলচ্চিত্রের গান- সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনবদ্য। শেষ জীবনে গান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। আজও তার গান নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে শ্রোতাদের। এ অমর শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়....

‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়, সে হারালো কোথায়, কোন দূর অজানায়, সেই চেনা মুখ কতদিন দেখিনি, তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি’- বাংলা গানের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজের গাওয়া এ গানের মতোই চিরদিনের জন্য সবার দৃষ্টিসীমার অন্তরালে হারিয়ে গেলেন দূর-অজানায়। দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে গেলেও আজও জনপ্রিয় তাঁর কণ্ঠের গান। বাংলা গানের এ কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আজীবন বেঁচে থাকবেন তাঁর অনবদ্য সব গান-সুরের মাঝে।

 

যেভাবে গানের ভুবনে...

শাহনাজ রহমতুল্লাহর ভাই আনোয়ার পারভেজ সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ও গায়ক। প্রখ্যাত গজলশিল্পী মেহেদী হাসানের কাছে শাহনাজ রহমতুল্লাহ গজল শিখেন। শাহনাজ রহমতুল্লাহর ১৯৬৩ সালে শাহনাজ বেগম হিসেবে গানের হাতেখড়ি। বাবার অনুপ্রেরণা আর মায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একেবারে ছোটবেলায় শাহনাজের গানে হাতেখড়ি। ১৯৬৩ সালে ১১ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ নামক চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর শিল্পীজীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালে প্রথম টেলিভিশনে তাঁর গাওয়া গান প্রচারিত হয়। তিনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দিন আলী, খান আতা প্রমুখের সুরে গান গেয়েছেন। পাকিস্তান আমলে উর্দু গজলসহ পাকিস্তান টিভি ও রেডিওতে গান গেয়েছেন। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গানের কণ্ঠজাদু দিয়ে সংগীতপ্রেমীদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন শাহনাজ রহমতুউল্লাহ। বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। ওই বয়সেই গুন গুন করে গান গাইতেন শাহনাজ। বিষয়টি বাবা এম ফজলুল হকের নজরে এসেছিল। ওই সময় নয় বছর বয়সী বড় বোনকে গানের তালিম দিতে বাসায় আসতেন ওস্তাদ মুনীর হোসেন। ভিকারুন নিসা স্কুলের শিক্ষার্থী তাঁর ওই বড় বোনটি ছিলেন তুখোড় মেধাবী সংগীতশিল্পী। বোন তালিম নেওয়ার সময় পাশে বসে থাকতেন শাহনাজ। অবশ্য ওই বোনটি পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবা ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী। বাবা মনে করেছিলেন গান গাইলে শাহনাজ বেশ ভালো করতে পারবে। তাইতো বাবা এম ফজলুল হকের উৎসাহ এবং মা আসিয়া হকের অনুপ্রেরণায় শাহনাজকে ওস্তাদ রেখে গান শেখানো শুরু করেন। বরেণ্য এ শিল্পী উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে। তিনি ওস্তাদ মনির হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছেও গানে তালিম নেন। গজল শিখেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি গজলসম্রাট মেহেদী হাসানের কাছে। পন্ডিত বারীণ মজুমদারের মাধ্যমে তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি এ গজলসম্রাটের সাহচর্য পান। খেলাঘরেও গান শিখেছেন তিনি। ওই সময়টায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁরা নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। ছোট্ট বয়সে পরিণত কণ্ঠের সুবাদে ওস্তাদের পাশাপাশি অন্য অনেকের প্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। শাহনাজ রহমতুল্লাহ সেই ছোট্ট বয়সে বেতারেও গাইতেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। দেশাত্মবোধক গানের জন্য সর্বসাধারণের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের শুরুর দিকেই প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ। মূলত তাঁরই অনুষ্ঠানে গাওয়া শাহনাজ রহমতুল্লাহর অনেক গান কালজয়ী হয়ে অগণিত মানুষের মন জয় করে। পাকিস্তানে থাকার সুবাদে করাচি টিভিসহ উর্দু ছবিতেও গান করেছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। সত্তরের দশকে অনেক উর্দু গান ও গজল গেয়ে সংগীতপিপাসুদের মাতিয়েছেন শাহনাজ। সেসব গানে এখনো মানুষ মুগ্ধতায় ভাসেন।

 

গান ছেড়ে ধর্মকর্মে মনোযোগী যে কারণে-

৫০ বছরের অধিক সময় ধরে গানের জগতে দাপুটে বিচরণ করা এ শিল্পী হঠাৎ করেই গানের জীবন থেকে নিজেকে আড়াল করে নেন। ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তির পর গান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবেই বিদায় নেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ২০০৮ সালের পর থেকে একেবারেই নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। জীবনের শেষ সময়ে এ গুণীশিল্পী গান ছেড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে ধর্মকর্ম পালনে মনোনিবেশ করেন। যা তাঁর মৃত্যুর আগে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে হঠাৎই গান ছেড়ে দিয়েছিলেন এ কিংবদন্তি শিল্পী। গণমাধ্যমেও ছিলেন অনুপস্থিত। এক জন্মদিনে শাহনাজ রহমতুল্লাহ বলেন, ‘এখন আসলে জীবনযাপন বদলে গেছে। সারাক্ষণ মহান আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন থাকি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই চেষ্টা থাকে আমার। আমি সবার জন্য দোয়া করি যেন সবাই সুস্থ থাকেন, ভালো থাকেন। মৃত্যুর আগে ওই সাক্ষাৎকারে শাহনাজ রহমতুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়- আর কি কখনো গাইবেন? জবাবে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কোনোদিনই গাইব না।’ গানের জগতে তার অনুপস্থিতিতে শ্রোতা ও ভক্তদের মন বারবারই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। তাঁর খোঁজখবর নিতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ গানের ভুবন থেকে নিজেকে কেন সরিয়ে নিলেন? গণমাধ্যমকর্মীর এমন প্রশ্নে সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন- আমার নামাজ পড়েই সময়টা বেশ কাটছে। ওমরাহ করে আসার পরের দিন থেকেই আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। তখন আমি নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম। তিনি আরও জানিয়েছিলেন- পবিত্র কাবা, মহানবী (সা.)-এর রওজা শরিফ দেখে আসার পর থেকে পার্থিব বিষয়ে আগ্রহী নন তিনি। বাকিটা জীবন সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতায় প্রার্থনা করেই কাটাতে চান। এ সময়ের গান কেমন হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন- সে বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। টিভি দেখেন না, রেডিও শোনেন না, তার সময় কাটে কীভাবে প্রশ্নে তিনি জানান, ভোর ৪টায় ঘুম থেকে ওঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। ফজর পর্যন্ত জায়নামাজে অপেক্ষা করতে থাকেন। ওয়াক্ত হলে ফজর পড়ে কোরআন শরিফ পড়া শুরু করেন। তিনি আরও জানান, একজন হুজুর বাসায় এসে পবিত্র কোরআন শিখিয়ে যান। এভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ আরও কিছু ধর্মীয় কাজ সারেন। তিনি জানান, এশার নামাজ শেষে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন যেন পরবর্তীতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে জাগতে পারেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকর্মীকে সেদিন আরও জানিয়েছিলেন, এখন হজে যাওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য। হাঁটুর ব্যথার কারণে হাঁটতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, একটু সুস্থ হলেই আমার স্বামী আমাকে হজে নিয়ে যাবেন। তিনি হজ করেছেন। এখন তিনি তাবলিগ করছেন। এ গুণীশিল্পীর জীবনের শেষ ইচ্ছা হজ করার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। এর আগেই মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় ইহজগতের মায়া ছিন্ন করে পরপারে পাড়ি জমান এ সুমধুর কণ্ঠের জাদুকর।

 

বিবিসির জরিপে তাঁর সেরা ৪ গান

২০০৬ সালে বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠের ছিল চারটি গান। সেই তালিকায় চারটি গানের মধ্যে ৯ নম্বরে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ১৩ নম্বরে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ১৫ নম্বরে ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’ গানটি রয়েছে ১৯ নম্বর স্থানে।

 

একুশে পদক ও অন্য সম্মাননা

এ গুণীশিল্পী ১৯৯২ সালে একুশে পদক, ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেন।

 

তার কালজয়ী যত গান

‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, ফুলের কানে ভ্রমর এসে’ (পিচঢালা পথ), ওই ঝিনুক ফোঁটা সাগর বেলায়, পারি না ভুলে যেতে (সাক্ষী), যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি, আমি সাত সাগরের ওপার হতে (কত যে মিনতি), শুনেন শুনেন জাঁহাপনা (সাত ভাই চম্পা), কে যেন সোনার কাঠি ছোঁয়ায় প্রাণে, আমি যে কেবল বলে তুমি (আগন্তুক), একটু সময় দিলে না হয় (সূর্য উঠার আগে), স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই, আবার কখন কবে দেখা হবে, যদি চোখের দৃষ্টি দিয়ে চোখ বাঁধা যায়, তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে, তুমি কি সেই তুমি, ও যার চোখ নাই (তাসের ঘর), ঘুম ঘুম ঘুম চোখে (ঘুড্ডি), আমি তো আমার গল্প বলেছি, বন্ধুরে তোর মন পাইলাম না, খোলা জানালায় চেয়ে দেখি তুমি আসছো, একটি কুসুম তুলে নিয়েছি, আমায় তুমি ডাক দিলে কে, ওই আকাশ ঘিরে সন্ধ্যা নামে, আমার ছোট্ট ভাইটি মায়ায় ভরা মুখটি, আষাঢ় শ্রাবণ এলে নেই তো সংশয়, কোন লজ্জায় ফুল সুন্দর হলো, বারোটি বছর পরে, আরও কিছু দাও না দুঃখ আমায়, আমি ওই মনে মন দিয়েছি যখন, আমার সাজানো বাগানের আঙিনায়, দিগন্ত জোড়া মাঠ, তোমার আলোর বৃন্তে, এই জীবনের মঞ্চে মোরা, মানিক সে তো মানিক নয়, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, আমায় যদি প্রশ্ন করে, একবার যেতে দে না আমার, এক নদী রক্ত পেরিয়ে, একতারা তুই দেশের কথা বল রে আমায় বল প্রভৃতি। ১৯৯০ সাল। ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবির তাঁরই গাওয়া- ‘সাগরের সৈকতে কে যেন দূর হতে’ গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ কণ্ঠসংগীত শিল্পীর সম্মান ওঠে তাঁর হাতে। দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর জনপ্রিয় গানের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। বলা যেতে পারে- তাঁর কোনো গানই শ্রোতার মন না ছুঁয়ে যায়নি।

সর্বশেষ খবর