শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

খলনায়ক থেকে সফল নায়ক

খলনায়ক থেকে সফল নায়ক

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক্সট্রা শিল্পী ও খলনায়ক থেকে সফল নায়ক হয়ে ওঠা একজন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের নাম জসিম। যিনি অভিনয়ের পাশাপাশি এদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশন দৃশ্যেরও প্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন। তাঁর স্বল্প কিন্তু সাফল্যমন্ডিত জীবন গল্পের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

চলচ্চিত্রে যাত্রার গল্প...

জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন জসিম। সারা দিন, সারা রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। সকালে লাইনে দাঁড়িয়ে পারিশ্রমিক পেয়েছেন ১০ টাকা। সে জায়গা থেকে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রিয় নায়ক। জসিম, একাধারে তিনি একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং মারপিট পরিচালক। বাংলাদেশি অ্যাকশন সিনেমাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে জসিমের অবদান অনস্বীকার্য। জসিম চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন ‘দেবর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে। এ ছবিতে জসিম চলচ্চিত্র পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও মূল পরিচিতি পান দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের অভিনয় করে। ছবিটি অমিতাভ বচ্চন, আমজাদ খান অভিনীত হিন্দি সিনেমা ‘শোলে’র রিমেক।

 

বলিউড অভিনেতা আমজাদ খানের প্রশংসা...

১৯৭৭ সালে দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির মাধ্যমে জসিম আলোড়ন তোলেন। বলিউডের ‘শোলে’র রিমেক ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটিতে জসিম অভিনয় করেন বলিউড অভিনেতা আমজাদ খানের অভিনীত চরিত্রে। এ চরিত্রটি করার জন্য জসিম প্রায় ২০ বার ‘শোলে’ ছবিটি দেখেছিলেন। তাঁর অভিনয় দেখে গব্বর সিং চরিত্রে রূপদানকারী আমজাদ খান প্রশংসা করেছিলেন। দোস্ত দুশমন ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত জসিম পরে আরও কিছু ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। খলনায়ক চরিত্রে অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- রংবাজ, রাজ দুলারী, দোস্ত দুশমন, তুফান, জবাব, নাগ-নাগিনী, বদলা, বারুদ, সুন্দরী, কসাই, লালু মাস্তান, নবাবজাদা, অভিযান, কালিয়া, বাংলার নায়ক, গরিবের ওস্তাদ, ভাইবোন, মেয়েরাও মানুষ প্রভৃতি।

 

খলনায়ক পর্বের সমাপ্তি...

জসিমের খলনায়ক চরিত্রে অভিনয়ের সমাপ্তি ঘটে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সবুজ সাথী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নায়ক হিসেবেই অভিনয় করে গেছেন।

 

যেভাবে নায়ক...

পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ‘অমর শরীফ’ সিনেমায় জসিমকে নায়ক হিসেবে বেছে নিলেন। সেই সময় সিনেমা এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। শতাধিক সিনেমায় নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন জসিম।

 

দেশীয় ছবিতে মারপিটের সূচনা...

বাংলাদেশের ছবিতে মারপিটকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জসিমের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। বলা হয়, ঢাকার ছবিতে জসিমই প্রথম মারপিটের সূচনা করেন। চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন বলেন, ‘জসিম যখন ফিল্মে যোগ দেন তখন থেকেই ঢাকায় হিন্দি ছবির কাহিনি চুরি করে ছবি নির্মাণের হিড়িক পড়ে গেল। জসিমকেও ওই সময় বেশ কিছু নকল ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও প্রতিভাগুণে জসিম একটা ভিন্ন স্টাইল সৃষ্টি করেছিলেন।’ জসিম-আরমান-মাহবুব এই তিনজন মিলে তৈরি করেছিলেন জেমস ফাইটিং গ্রুপ। যারা চলচ্চিত্রের মারপিট পরিচালনা করতেন এবং স্ট্যান্ট সরবরাহ করতেন। জসিম বলেছিলেন, অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল শুরু থেকেই। অভিনয় না করলেও পর্দার বাইরে আজীবন ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে থাকতে চেয়েছিলেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তিনি ন্যাশনাল কোচিং সেন্টার থেকে মার্শাল-জুডো শিখেছেন। সিনেমার ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে জসিম নিজেকে মেলে ধরেছিলেন মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে। পশ্চিমা সিনেমা থেকে ধারণা নিয়ে ফাইট প্রয়োগ করতেন তিনি। নায়কের সঙ্গে ফাইট করার সময় দর্শকরা ভিলেন জসিমের জন্য হাততালি দিতেন।

 

শাবানার প্রেমিক ও ভাইয়ের চরিত্রে সফল...

জসিমই দেশে একমাত্র নায়ক, যিনি কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার সঙ্গে প্রেমিক এবং ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। দুটি চরিত্রই দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ‘সারেন্ডার’ ছবিতে শাবানার প্রেমিক হিসেবে সফল হয়েছেন জসিম। সেই শাবানাই ‘সবুজ সাথী’, ‘অবদান’ ও ‘মাস্তান রাজা’ ছবিতে জসিমের বড় বোন হিসেবে সফল হয়েছিলেন।

 

রিয়াজকে চলচ্চিত্রে আনেন...

জসিমই আবিষ্কার করেছিলেন জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজকে। ১৯৯৪ সালে রিয়াজ চাচাতো বোন ববিতার সঙ্গে বিএফডিসিতে ঘুরতে গিয়ে জসিমের নজরে পড়েন। জসিম তখন তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ১৯৯৫ সালে জসিমের সঙ্গে ‘বাংলার নায়ক’ নামের একটি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন রিয়াজ।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা...

অভিনেতা জসিম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও বটে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছেন তিনি।

 

ব্যক্তিজীবন...

জসিমের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জে। চলচ্চিত্রে শুধু জসিম হিসেবে পরিচিত হলেও এই নায়কের আসল নাম আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন। জসিমের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ পর্যন্ত। তিনি অভিনেত্রী সুচরিতাকে বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন।  জসিমের তিন ছেলে। রাতুল, রাহুল, সামি। যার মধ্যে রাতুল ও সামি ব্যান্ডের বেজিস্ট ও ড্রামার। রাহুল ব্যান্ডের গিটারিস্ট। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে এফডিসির ২ নম্বর ফ্লোরের নামকরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা জসিম ফ্লোর।

সর্বশেষ খবর