বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছিলেন তিনি

পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছিলেন তিনি

সুজলা-সুফলা সোনার বাংলার পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছিলেন আবদুল জব্বার। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, স্বাধীনতাযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও গায়ক। ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের এইদিনে না ফেরার দেশে চলে যান। তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার এ দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। প্রয়াণ দিবসে তাঁকে জানাই ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

গানের জীবন শুরুর গল্প

আবদুল জব্বার ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সংগমের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে এতটুকু আশা ছবিতে সত্য সাহার সুরে তাঁর গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু’ গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। একই বছর ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে ‘সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো’ গানে কণ্ঠ দেন। রবীন ঘোষের সুরে তিনি পীচঢালা পথ (১৯৭০) ছবিতে ‘পীচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’ এবং নাচের পুতুল (১৯৭১) ছবির শিরোনাম গান ‘নাচের পুতুল’-এ কণ্ঠ দেন।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা জোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অংসখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুুদ্ধের সময় তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন। তৎকালীন কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গণসংগীত পরিবেশন করেছেন যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে সে সময় গণসংগীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ রুপি দান করেছিলেন। আশুতোষের কণ্ঠে ‘শুনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটা শুনেই তিনি আগরতলা যান। আগরতলার ছোট রেডিও স্টেশনেই দেশের একটা গান গাওয়ার সুযোগ পান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর গানই প্রথম বাজে।

 

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব স্নেহধন্য ছিলেন আবদুল জব্বার। সব সময় বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সম্বোধন করতেন ‘বাবা’ বলে, আর আবদুল জব্বারকে শেখ মুজিব ডাকতেন ‘গানপাগলা’ বলে। আবদুল জব্বার স্মৃতিকথায় বলেছিলেন- ‘তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বাবা (বঙ্গবন্ধু) একদিন আমাকে ডেকে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা গান বানা তো পাগলা।  যেই বলা সেই কাজ। বাবার আদেশ পালন করতে  ছোটে গেলাম কবি ও গীতিকার ফজল-এ-খোদার কাছে। লেখা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সেই গান-‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে’। সুর করে গানটি বাবার সামনেই গাইলাম। বাবা বিস্ময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কি চাস তুই আমার কাছে? মন্ত্রী হবি?’ আমার উত্তর ছিল ‘না’। ‘বেতারের বড় একটা চেয়ার দেই?’ এবারও আমার উত্তর ‘না’। তখন বাবা বলেছিলেন, ‘তাহলে তুই কি চাস?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘আমার এখনো অনেক গান গাওয়া বাকি আছে। আমি সারা জীবন গানই গাইতে চাই।’ বাবা তখন আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ওরে পাগলা, তুই তাইলে সারা জীবন গানই গা।’

 

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবিতে উত্তাল সারা দেশ। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন সময় আবদুল জব্বার গেয়ে চলেছেন, ‘আমাদের দাবি যারা মানে না, পিটাও তাদের পিটাও; বন্দি করে যদি ওরা ভাবে খেলা করেছি শেষ, তা হবে মস্ত বড় ভুল।’ মানুষের অধিকার আদায়ের গান গাইতে গাইতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিও হতে হয়েছিল আবদুল জব্বারকে। জাতির পিতা আগরতলা মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যে কয়জন মানুষের খোঁজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘গানপাগলা’ আবদুল জব্বার। তাঁকে দেখলেই বঙ্গবন্ধু বুকে জড়িয়ে নিতেন।

দেশপ্রেমী এই শিল্পীকে এতটাই পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। এমন একজন শিল্পীর কণ্ঠেই মানায়- ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’, ‘মুজিব বাইয়া যাও রে, অকূল দরিয়ায়’, ‘সাত কোটি মানুষের একটাই নাম, মুজিবর’, অথবা ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’।

 

বিবিসির জরিপে তাঁর সেরা ৩ গান

তাঁর গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালের মার্চ মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়।

 

যেভাবে সিনেমার গানে...

আবদুল জব্বার, রেডিওর শিল্পী ছিলেন। ‘নতুন সুর’ সিনেমার জন্য রবিন ঘোষ ভাবলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ফেরদৌসি রহমানকে ডুয়েট করাবেন। কেজি মোস্তফা জানালেন, ‘একটা ছেলে আছে হেমন্তের মতো গায়’। ফেরদৌসি রহমান জানালেন, ‘হ্যাঁ বাসায় আসছিল আমার, গায় ভালো।’ সেই থেকে শুরু জব্বার সাহেবের সিনেমায় গান গাওয়া।

 

প্রথম অ্যালবাম

১৯৭৮ সালে সারেং বৌ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি দর্শকপ্রিয়তা পায়। ২০১৭ সালে এই সংগীতশিল্পীর প্রথম মৌলিক গানের অ্যালবাম ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া মুক্তি পায়’। একই বছর তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গানের অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। গীতিকার আমিরুল ইসলাম রচিত ‘বঙ্গবন্ধু দেখেছি তোমায় দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দেওয়ার আগেই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যালবামের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

 

পারিবারিক জীবন

কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বারের প্রথম স্ত্রী হালিমা জব্বার একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর এক মেয়ে দুই ছেলে মিথুন জব্বার এবং বাবু জব্বার। তাঁরাও কণ্ঠশিল্পী। দ্বিতীয় স্ত্রী শাহীন জব্বার ছিলেন গীতিকার। তাঁদের মেয়ে মুনমুন জব্বার নৃত্যশিল্পী। তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ডলি জব্বার বাংলাদেশ বেতারের একজন কর্মকর্তা।

 

যত সম্মাননা

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৮০), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬), বাচসাস পুরস্কার (২০০৩), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস-আজীবন সম্মাননা (২০১১) ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।

সর্বশেষ খবর