শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এক ধূমকেতুর রহস্যঘেরা পতন...

এক ধূমকেতুর রহস্যঘেরা পতন...

‘সাত সামুন্দার পার’ কিংবা ‘অ্যায়সে দিওয়ানে হি’ গান শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে এক মিষ্টি মেয়ের মুখ, নব্বই দশকের শুরুর দিকে বলিউডে সাড়া জাগানো অন্যতম অভিনেত্রী দিব্যা ভারতী। বলিউডের আকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত স্বল্পায়ু এ অভিনেত্রী মাত্র পাঁচ বছর অভিনয়জীবনে প্রায় ২১টি সিনেমায় অভিনয় করেন। খ্যাতির শিখরে অবস্থানকালে আকস্মিক তাঁর মৃত্যুর খবর সবার কাছে ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি হত্যা? তা ৩০ বছর পর আজও সবার কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। দিব্যার জীবনের সাতসতেরো তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন?

ট্রয় রিবেইরো নামের এক নামি লেখক দিব্যাকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। ট্রয়ের বই অনুযায়ী দিব্যা মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে মদ্যপান করেছিলেন। বাড়িতে একাধিক অতিথি এসেছিলেন। দিব্যা নিজের গ্লাস ভর্তি করে বারান্দায় একা সময় কাটাচ্ছিলেন। পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে যান। ট্রয় জানিয়েছেন, অতিথিরাই হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন তাঁকে। ১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল পাঁচতলা থেকে পড়ে প্রয়াত হন দিব্যা। যখন সবাই টের পান তখন দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি ১৯ বছরের অভিনেত্রীকে।

মৃত্যুর আগে ও পরের ঘটনা

ট্রয়ের লেখা থেকে জানা যায়, দিব্যার বাবা ও ভাইকে সামলানো যাচ্ছিল না। বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ওরা আমার মেয়েকে মেরে ফেলল!’ ভোরবেলা দিব্যার মা হাসপাতালে পৌঁছেন। তিনি বিশ্বাসই করছিলেন না। তবে হাসপাতালেই দিব্যার বাবা ও ভাই মাকে দোষারোপ করছিলেন। যার কারণ আজও অজানা। দিব্যার বন্ধু পুলিশকে জানান, মৃত্যুর সময় নীতা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। দিব্যা বারান্দার রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছিলেন। নীতা বাঁচানোর জন্য এগোতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে দিব্যার ঝাঁপ। সেদিন সন্ধ্যাবেলা সাজিদের সঙ্গে বিবাদ হয়। সাজিদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। দিব্যা হুমকি দিয়েছিলেন, ‘তুমি যদি ১০ মিনিটে ঘরে না ঢোক, আমাকে আর দেখতে পাবে না।’ দিব্যার বন্ধু জানান, সাজিদ হুমকিকে পাত্তা দেননি।

 

সাজিদের সঙ্গে ঝগড়া ও ঘুমের ওষুধ সেবন

দিব্যার আরেক প্রতিবেশী বলেন, সেদিন সাজিদের সঙ্গে ঝগড়ার পর অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খান দিব্যা। সাজিদ ভয় পেয়ে তাঁদের প্রতিবেশী নীতা লুল্লা ও তাঁর স্বামীকে ডাকেন। তাঁরা এসে দিব্যার ভাই এবং সাজিদকে বের করে দেন। বলেন, তিনি দিব্যার সঙ্গে আলাদা কথা বলবেন। পরিচারিকাকে থাকতে বলা হয়। তিনি ছিলেন রান্নাঘরে। দিব্যা রান্নাঘরে আরও মদ্যপান করে সবার অলক্ষ্যে বারান্দায় চলে যান। কয়েক মুহূর্ত পরই সব শেষ হয়।

 

স্বামীর পরিকল্পিত হত্যাকান্ড?

দিব্যা ভারতীর অধিকাংশ ভক্তের ধারণা, এটা ছিল তাঁর স্বামী সাজিদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। সাজিদ, নীতা ও তাঁর স্বামীর মাধ্যমেই এ হত্যাকান্ড ঘটায় বলে গুঞ্জন ওঠে। তদন্তের সময় এই মৃত্যুর রহস্য ভেদ করতে মুখোমুখি হতে হয়েছিল আরও অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার। গুজব আছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের আবু সালেম বা দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে সংযোগ ছিল সাজিদের। ১৯৯৩ সালের ১৩ মার্চ, মুম্বাইয়ে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের কোনো তথ্যের সাক্ষী ছিলেন দিব্যা, যার ফলে তাঁকে মেরে ফেলা জরুরি ছিল এমনও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। কারণ অনেকের মতে, তদন্তের রিপোর্ট ছিল টাকা দিয়ে সাজানো। তাই সেদিন রাতে ওই দুজন ছাড়া সেখানে কেউ ছিল কি না এ বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। এমনকি কর্তব্যরত পুলিশ অমীমাংসিত অবস্থায় এ হত্যার ফাইল বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে চাকরি হারান ১৯৯৮ সালে। তাই দিব্যার মৃত্যুর ঘটনা অর্থের বিনিময়ে সাজানো- এ ধারণাও অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়নি। তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথাই বলা হয়েছে।

 

নায়ক গোবিন্দর  সঙ্গে প্রেম

‘শোলা অউর শবনম’-এ অভিনয়ের সময় গোবিন্দর সঙ্গে আলাপ। জানা যায়, তাঁদের মধ্যেও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দিব্যার সম্পর্কে গোবিন্দ বলেছিলেন, ‘দিব্যাকে আমার ভালো লাগে। এত মোহময়ী যে তাঁর সামনে পুরুষরা নিজেকে সামলাতে পারে না। কিন্তু দিব্যার মোহে পা দিইনি আমি এখনো।’

 

যেভাবে সাজিদের সঙ্গে পরিচয়

গোবিন্দর মাধ্যমে পরিচয় প্রযোজক সাজিদ নাদিওয়াদওয়ালার সঙ্গে। তার পর বন্ধুত্ব, প্রেম। ১৯৯২ সালের ১০ মে বিয়ে। তারপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। নতুন নাম সানা নাদিওয়াদওয়ালা। অভিনয়ে যাতে প্রভাব না পড়ে তাই বিয়ের কথা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

 

অভিনয়ে যেভাবে

দিব্যা ভারতী বব্বিলি রাজা (১৯৯০) ছবির মাধ্যমেই বলিউডে পা রেখেছিলেন। ছবিটি তেলেগু ভাষায় নির্মিত হয়েছিল। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা। তারপর অভিনয়ে। প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিশ্বাত্মা’। ‘শোলা অউর শবনম’, ‘দিওয়ানা’ সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। ‘দিওয়ানা’-তে শাহরুখ খানের বিপরীতে। সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা ঋষি কাপুরও। ছোট থেকেই দিব্যার অভিনয় জগতে ভীষণ আগ্রহ ছিল। অল্প বয়সেই হিন্দি গানের সঙ্গে নাচে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। স্কুলের পড়া বাদ দিয়েই তিনি অনুশীলন করতেন অভিনয় আর নাচে। ১৯৯২ সালে সানি দেওলের বিপরীতে রাজিব রাই পরিচালিত ‘বিশ্বাত্মা’ ছবির প্রস্তাব পান তিনি। মুক্তির পর সিনেমাটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সিনেমাটির প্রতিটি গানই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

অবিশ্বাস্য ঘটনা

‘রং’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন আয়েশা জুলকা এবং দিব্যা ভারতী। আয়েশা জানিয়েছিলেন, দিব্যার মৃত্যুর পর যখন ছবির ট্রায়াল হয় তখনই এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। যখনই দিব্যা স্ক্রিনে আসেন তখনই স্ক্রিন ভেঙে পড়ে। সেই ঘটনা আজও ভোলেননি আয়েশা।

 

শেষ সিনেমা

জীবদ্দশায় তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ সিনেমা ‘ক্ষত্রিয়’। মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন আগে মুক্তি পায় এবং সিনেমাটিও ছিল ব্যবসা সফল। এ ছাড়া তাঁর অসমাপ্ত কাজ তেলেগু ছবি ‘থোলি মুডধু’ এবং হিন্দি ‘রং’ ও ‘শতরঞ্জ’ মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর। সিনেমা তিনটিই অন্য অভিনেত্রীদের দিয়ে ডাবিং করা হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর