শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ট্রাকড্রাইভার থেকে শীর্ষ অভিনেতা

ট্রাকড্রাইভার থেকে  শীর্ষ অভিনেতা

দর্শকনন্দিত ‘রোমান হলিডে’। যে ছবি আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে সবার। আর ছবিটি হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠার মূলে ছিল যাঁর জীবনধর্মী অভিনয় তিনি হলেন হলিউডের শীর্ষ অভিনেতা গ্রেগরি পেক। অভিনয়ের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। তাঁর কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

গ্রেগরি পেক ছিলেন ট্রাকড্রাইভার

একটি তেল কোম্পানিতে ট্রাকড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। বার্কলেতে পড়ার পাশাপাশি কাজ করতে হতো গ্রেগরি পেককে। টিউশন ফি এবং নিজের জীবনযাত্রার খরচ চালানোর জন্য বেশ পরিশ্রম করতেন। একসময় তিনি বার্কলের অভিনয় প্রশিক্ষকের নজরে পড়েন। তাঁর মধ্যে প্রতিভার পরিচয় পেয়ে প্রশিক্ষক তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদলে নেন। সে সময় তিনি পাঁচটি নাটকে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা পান এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন।

 

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই

ইংরেজিতে স্নাতক হওয়ার পর তিনি পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। সেখানে পেক অভিনয়ে তালিম নেন বিখ্যাত নাট্যশিক্ষক স্যানফোর্ড মেইসনারের কাছে। সেদিনগুলোতে তরুণ পেককে অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে ভীষণভাবে। কখনো কখনো তাঁকে খাবারের বিনিময়ে কাজ করতে হতো। কখনো মাথার ওপর ছাদটুকুও থাকত না। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে রাতে ঘুমিয়েছেন অনেকদিন। তবে সাফল্যের মুখ দেখতে খুব বেশি দেরি হয়নি। মঞ্চনাটকে তিনি সুযোগ পান। এবং তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়।

.

প্রথম ছবিতেই সফল

গ্রেগরি পেকের প্রথম ছবি ‘ডেইজ অব গ্লোরি’ মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালে। প্রথম ছবিতেই নিজের জাত চিনিয়ে দেন এই অভিনেতা। পরপর মুক্তি পায় ‘দ্য কিজ অব দ্য কিংডম’ (১৯৪৪), ‘দ্য ইয়ার্লিং’(১৯৪৬), ‘জেন্টলম্যানস অ্যাগ্রিমেন্ট’ (১৯৪৭) এবং ‘টুয়েলভ ও ক্লক হাই’ (১৯৪৯)। চারটি ছবির জন্যই একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান তিনি। ‘দ্য ইয়ার্লিং’ ছবিতে কৃষক চরিত্রে অভিনয় করে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পান।

 

বিখ্যাত যত চরিত্র

১৯৪৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আলফ্রেড হিচককের ‘স্পেল বাউন্ড’ ছবিতে একজন স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যক্তির চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন তিনি। পরবর্তীতে উত্তম কুমার যখন ‘হারানো সুর’ ছবিতে স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন তখন ‘স্পেল বাউন্ড’-এ গ্রেগরি পেকের অভিনয়কে অনুসরণ করেন বলে স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন। ‘স্পেল বাউন্ড’ তাঁকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়। ‘ডুয়েল ইন দ্য সান’ (১৯৪৬) ছবিতে আবেগপ্রবণ, নিষ্ঠুর কাউবয়ের চরিত্রে তাঁর শক্তিশালী অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘রোমান হলিডে’ নামের সর্বকালের অন্যতম সেরা রোমান্টিক ছবি। এ ছবিতে অভিনয় করে অড্রে হেপবার্ন অস্কার পেয়েছিলেন। ‘দ্য গান ফাইটার’ (১৯৫০), ‘দ্য বিগ কান্ট্রি’ (১৯৫৮), ‘মবি ডিক’ (১৯৫৬), ‘দ্য গানস অব নাভারন’সহ (১৯৬১) অনেক ছবিই তাঁকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ‘মবি ডিক’-এর প্রতিশোধপরায়ণ নাবিক, ‘দ্য গানস অব নাভারন’-এর লড়াকু সৈনিক, ‘গান ফাইটার’-এর ওয়েস্টার্ন কাউবয় সব চরিত্রেই তাঁর পুরুষালি অবয়ব ও অসাধারণ অভিনয় তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। ১৯৬২ সালে মুক্তি পায় ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’। এই সিনেমাটি শুধু পেকের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ছবিই নয়, এটি হলিউডেরও সেরা নির্মাণ। এতে আইনজীবীর চরিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেতার অস্কার জিতে নেন পেক। ২০০৩ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যাটিকাস ফিঞ্চ চরিত্রকে শত বছরের সেরা চলচ্চিত্র নায়ক বলে অভিহিত করে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে পেক বলেছিলেন ফিঞ্চ তাঁর প্রিয় চরিত্র। কারণ এর মধ্য দিয়ে তাঁর নিজস্ব মানবতাবাদী দর্শন প্রতিফলিত হয়েছিল। এই চরিত্রের মধ্যে তিনি নিজের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। ‘ডেভিড অ্যান্ড বাথসেবা’র মতো পৌরাণিক ছবিতে রাজা ডেভিড, ‘বয়েজ ফ্রম ব্রাজিল’-এর পলাতক নাৎসি, ‘ওমেন’ ছবির বিভ্রান্ত রাষ্ট্রদূত, ‘সি উলভস’-এর দুর্ধর্ষ নাবিক অথবা ‘দ্য মিলিয়ন পাউন্ড নোটের’ গরিব থেকে ধনী বনে যাওয়া ভদ্রলোক- সব ভূমিকায়ই তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। টিভি সিরিজ ‘দ্য স্কারলেট অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক’-এ ভ্যাটিকানের এক ধর্মযাজকের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পান গোল্ডেন গ্লোব।

 

যত অর্জন

১৯৬২ সালে ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ চলচ্চিত্রে অ্যাটিকাস ফিঞ্চ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘দ্য কিজ অব দ্য কিংডম’ (১৯৪৪), ‘দ্য ইয়ার্লিং’ (১৯৪৬), জেন্টলম্যানস অ্যাগ্রিমেন্ট’ (১৯৪৭) ও ‘টুয়েলভ ও ক্লক হাই’ (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের জন্য আরও চারটি একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন পান। তাঁর অভিনীত অন্যান্য সফল চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘স্পেল বাউন্ড’ (১৯৪৫), ‘দ্য গান ফাইটার’ (১৯৫০), ‘রোমান হলিডে’ (১৯৫৩), ‘মবি ডিক’ (১৯৫৬), ‘দ্য বিগ কান্ট্রি’ (১৯৫৮), ‘দ্য ব্রেভাডস (১৯৫৮)’, ‘পর্ক চপ হিল (১৯৫৯)’, ‘দ্য গানস অব নাভারন’ (১৯৬১), ‘কেপ ফেয়ার’ (১৯৬২) ও এর ১৯৯১-এর পুনর্র্নির্মাণ, ‘হাউ দ্য ওয়েস্ট ওয়াজ ওন’ (১৯৬২), ‘দ্য ওমেন’ (১৯৭৬), ‘দ্য বয়েজ ফ্রম ব্যাজিল’ (১৯৭৮), ও ‘ম্যাকেনাস গোল্ড’ অন্যতম।

 

মেডেল অব ফ্রিডমে ভূষিত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন পেককে তাঁর আজীবন মানবহিতৌষী কর্মের জন্য ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমে ভূষিত করেন। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা ধ্রুপদী হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সেরা পুরুষ তারকা তালিকায় তাঁর অবস্থান ১২তম।

 

শীর্ষ অভিনেতার তালিকায়

হলিউডে গ্রেগরি পেকের নাম রয়েছে শীর্ষ তালিকায়।

৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার গ্রেগরি পেক তাঁর অসাধারণ কণ্ঠ ও বাকভঙ্গিমার কারণে জয় করে নিয়েছিলেন দর্শকমন। বাংলাদেশের দর্শক তাঁর ‘গানস অব নাভারন’, ‘স্পেল বাউন্ড’, ‘মবি ডিক’ ছবিগুলোর কথা মনে রাখবে। আর বিশেষভাবে মনে রাখবে ‘রোমান হলিডে’ ছবির কথা। ১৯৬২ সালে এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য অস্কার জয় করেছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সেরা অভিনেতার নাম ঘোষণা করার জন্য উপস্থাপক     ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা মঞ্চে ডেকে নেন ‘টু উইমেন’খ্যাত সোফিয়া লরেনকে। গ্রেগরি পেক ওই বছর পুরস্কারের আশা করেননি। কিন্তু সোফিয়া লরেন যখন গ্রেগরি পেকের নাম ঘোষণা করলেন, তখন উদ্ভাসিত হলো পেকের মুখ। হলভর্তি মানুষের করতালি যেন থামছিলই না।

 

সামাজিক কর্মকান্ড

ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী পেক অনেক মানবতাবাদী সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন। একাডেমির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থক পেক রাজনীতিতে যোগ দেননি অনেক অনুরোধেও। তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। আইরিশ বংশোদ্ভূত পেক আয়ারল্যান্ডেও অনেক সমাজসেবামূলক কাজে অর্থ দান করেছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি একাডেমির ‘জিন হারশল্ট হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড’ পান।

সর্বশেষ খবর