রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অনন্তকালের এক মহানায়ক

অনন্তকালের এক মহানায়ক

ঠিক কোন বিশেষণে ভূষিত করলে উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনের বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরা যায়, তা বহুবার বিভ্রান্ত করেছে বাঙালিকে। কখনো ‘মহানায়ক’ কখনো ‘ম্যাটিনি আইডল’- এমন বহু সম্মানের মধ্য দিয়ে উত্তম কুমারকে আপন করে নিয়েছেন তাঁর গুণমুগ্ধরা। আজ এই অতি উত্তমের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সর্বকালের সেরা পুরুষ

‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ হোক কিংবা ‘সূর্য ডোবার পালা’, উত্তম কুমার যে সব মানুষের মনে-প্রাণে আজও বিরাজ করে তা নিঃসন্দেহে মানতে হবে। বাংলা সিনেমার জগৎ যদি সর্বকালীন সেরা সুন্দর পুরুষ পেয়ে থাকে তবে তা শুধু তিনিই। আজ ৩ সেপ্টেম্বর, মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্মবার্ষিকী। সর্বকালের সেরা এই অভিনেতা ১৯২৬ সালের এই দিনে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। উত্তম কুমারের আসল নাম অরুণ কুমার চ্যাটার্জি। তিনি ওপার-এপার দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয়। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চিত্রপরিচালনা এবং প্রযোজনাও করেন। কিন্তু সফলতা তাঁর মহানায়ক হিসেবেই।

 

ইনিই হলেন ইন্ডাস্ট্রি

তিনি অভিনয় করেছেন মঞ্চেও। এমন কোনো চরিত্র  নেই যাতে তিনি অভিনয় করেননি। এখনো টলিউডে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে তা হলো- ‘ইনিই হলেন ইন্ডাস্ট্রি’। অর্থাৎ উত্তম কুমার বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ঈশ্বর। তাঁর হাত ধরেই আসে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে স্বর্ণযুগ।

এই শরতে ধরণিকোলে

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের ‘মহানায়ক’ খেতাবটি একান্ত নিজের করে নিয়েছেন উত্তম কুমার। সুদর্শন চেহারা, চোখ ধাঁধানো চাহনি আর সুদক্ষ অভিনয় দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রকে করেছেন সমৃদ্ধ। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অভিনেতারা। ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখার পর দেখা গেল আজ ৩ সেপ্টেম্বর। মানে প্রকৃতিতে চলছে শরৎ। আকাশে সাদা মেঘের কুলি, কখনো একটুখানি বৃষ্টির ভেজা গল্প আর থেমে থেমে বাতাসের হেলেদুলে চলা। এসবের ফাঁকে মনে পড়ে যায় শরতের এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই শিল্পী, যিনি রীতিমতো পাল্টে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস। নায়করূপে নিজের মতো করে লিখেছেন নতুন মহাকাব্য। হয়তো এই শরতের ঝিরিঝিরি হাওয়ার পালে ভেসে তাঁর কানে ঠিকই পৌঁছে যাবে বিশেষ দিনের এই ভালোবাসা। শুভ জন্মদিন মহানায়ক।

 

তিনিই অনুপ্রেরণার উৎস

উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে অনুপ্রেরণার একটা জ্বলজ্বলে উদাহরণ পাওয়া যায়। একেবারে ব্যর্থ অবস্থা থেকে একজন মানুষ কীভাবে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করতে পারেন, তা উত্তম কুমার দারুণভাবে দেখিয়ে গেছেন। পরিবারের টানাপড়েনের কারণে উত্তম কুমারকে শিক্ষাজীবনেই পা বাড়াতে হয়েছে চাকরিতে। উত্তম কুমারের সংসারে ছিল অভাব-অনটন। তাই পড়াশোনা শেষ না করেই কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে ক্লার্ক হিসেবে চাকরি নিতে হয়েছিল তাঁকে। তখন আহিরীটোলায় নাট্যদল সুহৃদ সমাজে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন তিনি। কিন্তু ইতিহাস গড়ার জন্য যাঁর জন্ম, তাঁর কি চাকরিতে পড়ে থাকা চলে। মনের ভিতর অভিনয়ের স্বপ্নটা লালন করতে থাকেন উত্তম। তিনি হয়তো জানতেন তাঁর দৌড় বহুদূর। তাই অরুণ থেকে নিজের নাম বদলে রাখেন উত্তম কুমার। ভাগ্যের চাকা ঘুরে কখন জানি এসে পড়ে ডাক; সে আশায় থাকলেন অপেক্ষায়। অপেক্ষার অবসান হলো ভারত স্বাধীনের বছর। ১৯৪৭ সালে ‘মায়াডোর’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেলেন উত্তম। কিন্তু না, বড় কোনো চরিত্র নয়; এক্সট্রা আর্টিস্ট হিসেবে। ফলাফল কারও নজরে না আসা। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’-এ অভিনয়। এখানেও তেমন উল্লেখযোগ্য চরিত্র নয়। তার পরের বছর পেলেন মূল চরিত্র। মানে নায়ক। সিনেমার নাম ‘কামনা’। সিনেমাটি মুক্তির পর মুখ থুবড়ে পড়ল। উত্তমের নায়করূপে আত্মপ্রকাশ হলো ভরাডুবির মধ্য দিয়ে। এখানেই শেষ নয়, এরপর থেকে টানা আট বছরে আটটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। যার সবকটিই হয়েছে ব্যর্থ। এজন্য তিনি পেয়েছিলেন ‘ফ্লপমাস্টার’-এর খেতাব। সেই ফ্লপমাস্টারই একসময় হয়ে ওঠলেন সুপারস্টার; হিটমাস্টার। কোটি দর্শকের প্রাণের স্পন্দন, তরুণী-যুবতীদের স্বপ্নের নায়ক। পরিবর্তনের গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। অবশ্য তার আগে ১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ এবং ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন উত্তম কুমার। ১৯৫৪ সালে তিনি চলে আসেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সে বছর তিনি ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। যার অধিকাংশই ছিল সফল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এ যেন বাস্তব জীবনে সফলতার স্বপ্নে বিভোর এক যুবকের ব্যর্থতাকে হারিয়ে দিয়ে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মহা এক গল্প।

 

যেভাবে অতি উত্তম

উত্তম কুমার তৈরি করলেন নিজের স্টাইল। ব্যায়াম করা চেহারা, নিজের নামের আদ্যক্ষর ইউ কাট চুল, চোখে বাঁকা চাহনি, ভুবন ভুলানো হাসি। আর তার সঙ্গে মিলল অপূর্ব কণ্ঠস্বর। সবমিলিয়ে ঘাম ঝরিয়ে হয়ে ওঠলেন অতি উত্তম। বাঙালির রুপালি পর্দার ম্যাটিনি আইডল, হার্টথ্রব উত্তম কুমার। যিনি আজও সবার মনের আসনে বিরাজ করছেন। তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গি, সিগারেট খাওয়ার স্টাইল এত বছর পরও পুরনো হয়ে যায়নি। যে কোনো চরিত্রেই তাঁর সাবলীল অভিনয় দর্শকদের মন জয় করেছে। তবেই না তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সবার প্রিয় মহানায়ক।

 

গায়ক হতে চেয়েছিলেন

গায়ক হতে চেয়েছিলেন। সে জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে রীতিমতো গান শিখেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু বুঝেছিলেন সেটা হবে না। কিন্তু সংগীতচর্চা ছিল।

 

প্রিয় ‘বাদশাহ’, ‘বেগম’ ও ‘বিন্দুবাসিনী’

পরিবার ও অভিনয় ছাড়াও উত্তম কুমারের প্রিয় ছিল আরও তিন সদস্য। যাদের খুবই ভালোবাসতেন। ব্যস্ততার মাঝেও এদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভুলতেন না। এরা হলো দুটি স্পিচ প্রজাতির কুকুর। এদের নাম বাদশাহ ও বেগম। সময় পেলেই এদের সঙ্গে খেলা করতেন। মাঝে মধ্যে শুটিং সেটেও আসত তারা। দুটি স্পিচ ছাড়াও একটি লাসা ছিল। যার নাম ছিল বিন্দুবাসিনী। সেও অভিনেতার আদরের এক পোষ্য ছিল। উত্তম কুমার শুটিং সেরে ফেরার পর এদের উন্মাদনা দেখার মতো ছিল। মহানায়কের কোলে উঠে পড়ত এই তিন পোষ্য।

 

বিকল্প ধারায়ও আলো জ্বাললেন...

 তিনি বিকল্প ধারায়ও হয়েছেন সফল। ‘নায়ক’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমায় অভিনয় করে সেরা অভিনেতা হিসেবে অর্জন করেছিলেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়া ‘উত্তর ফাল্গুনী’ সিনেমার জন্য প্রযোজক হিসেবেও পেয়েছেন জাতীয় সম্মান। অভিনয় ছাড়াও প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। দুটি ছোট গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি।

 

মুগ্ধ লিজ টেলর

হলিউড অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের মন জয় করেছিল ‘নায়ক’। উত্তম কুমারের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর।

 

শেষ যাত্রা

১৯৮০ সালে ‘ওগো বন্ধু সুন্দরী’ সিনেমার শুটিং চলছে। হঠাৎ স্ট্রোক করেন উত্তম কুমার। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। সে বছরের ২৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উত্তম। ভবানীপুরে মৃত্যুর পর কলকাতায় আনা হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কলকাতায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়। হাজার হাজার ভক্ত রাস্তায় নেমে আসে প্রিয় নায়ককে শেষবারের মতো দেখার জন্য, শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য। প্রায় চার দশক হয়ে গেছে উত্তম কুমার নেই। কিন্তু তাতে কী। না থেকেও তো তিনি আছেন আরও বেশি গভীরভাবে, দর্শকদের হৃদয়ে অনন্তকালের মহানায়ক হয়ে।

সর্বশেষ খবর