সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেহাল দশায় এফডিসি

কর্মশূন্য, বেতন-ভাতা অনিয়মিত, গ্র্যাচুয়িটি বন্ধ, পেনশনও নেই

বেহাল দশায় এফডিসি

এফডিসির আঙিনায় কান পাতলে এখন আর লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন বা কাট শব্দগুলো কানে বাজে না। প্রায় কর্মশূন্য এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এফডিসির বেহাল দশার চালচিত্র তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদমোস্তফা মতিহার

চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগারখ্যাত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) এখন প্রায় কর্মশূন্য। এখানে কমপক্ষে একদশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যামেরা, লাইট, অ্যাকশন এখন অনেকটাই অতীত। ফলে আয় আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা এবং অবসরে যাওয়ারা গ্র্যাচুয়িটি না পেয়ে অনবরত মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এফডিসির প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির ২৫১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক বেতন প্রায় ১ কোটি ২ লাখ টাকা। এছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ নানা খরচ। গত একদশক ধরে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না তাঁরা। অর্থের অভাবে পরিশোধ করা যাচ্ছে না বলে বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি টাকারও বেশি। সর্বশেষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসের জন্য এফডিসির সামনের রাস্তাটি অধিগ্রহণ বাবদ এফডিসিকে সরকার যে ৬ কোটি টাকা প্রদান করে তা এফডিআর করে রাখা হয় এবং তা থেকে লোন নিয়ে বেতন পরিশোধ চলছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফসিডিসির এক কর্মকর্তা জানান, এই এফডিআর থেকে গত জুলাই মাসের বেতন সবশেষ পরিশোধ করা যাবে। এরপর আর ওই খাত থেকে লোন নেওয়া যাবে না। ফলে আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ। এফডিসির ভুক্তভোগী চাকরিজীবীরা চরম দুঃখ নিয়ে বলেন আমরা আবারও মানবেতর জীবনযাপনের কবলে পড়ছি। সরকার কেন আমাদের প্রতি এমন উদাসীন জানি না। এদিকে, গত চার-পাঁচ বছরে অবসরে যাওয়া এফডিসির ৫৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁদের গ্র্যাচুয়িটি বাবদ পাওনা সাড়ে ১২ কোটি টাকা এখনো বুঝে পাননি। তাঁরা কোনো পেনশনও পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন তাঁদের প্রাপ্য পেতে নানা আবেদন-নিবেদন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়াও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ জানিয়ে কজন ভুক্তভোগী বলেন, আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা না পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দিনের পর দিন উপোস করছি। অর্থের অভাবে চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে। উপোস আর হতাশায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে এ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে আটজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। বাকিদের বেশির ভাগের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানায় এদের অনেকে। এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানায় বাণিজ্য ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে বারবার ধরনা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।

এদিকে, এফডিসিতে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শূন্যস্থান পূরণেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে হতাশা জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, আমরাই নিয়মিত বেতন পাচ্ছি না, মানবেতর জীবনযাপন করছি আবার নতুন নিয়োগ দিয়ে তাদের চালানো যাবে কীভাবে।

এদিকে, এফডিসি বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থা ও চলচ্চিত্র সমিতির কাছ থেকে বকেয়া হিসেবে পাবে আনুমানিক ২৩ কোটি টাকারও বেশি। সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা বলছেন এই অর্থ যদি পাওনাদারদের কাছ থেকে পাওয়া যেত তাহলে এফডিসি অর্থ সংকটের কবল থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পেত। পরিশোধ করা যেত অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুয়িটির টাকাসহ মাসিক বেতন এবং অন্যান্য নিয়মিত খরচ।  কেন এই পাওনা উদ্ধার করতে পারছে না এফডিসি এমন প্রশ্নে সংস্থার এক কর্তা বলেন, অনেক প্রযোজক তাঁদের অফিস ও বাসার ঠিকানা পাল্টিয়ে কোথায় চলে গেছেন তার হদিস মিলছে না। বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মামলাও হয়েছে। তবে এর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এফডিসির অন্য একটি সূত্র জানায় প্রায় শতাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার কাছে ১৯৮৪ সাল থেকে বকেয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণের সুবিধা ও পি ফিল্ম প্রথায় চলচ্চিত্র নির্মাণ বাবদ এফডিসির পাওনা রয়েছে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, বারবার বকেয়া পরিশোধের নোটিস পাঠিয়েও নির্মাতাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। এফডিসিতে নিবন্ধন করা বেশির ভাগ নির্মাতা ও প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় গিয়ে তাঁদের বাড়ি বা অফিসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। টেলিফোন নম্বরও বন্ধ। যাঁদের পাওয়া যাচ্ছে তাঁরা চলচ্চিত্রের ব্যবসা মন্দ এই অজুহাত দেখিয়ে শুধুই সময় নিচ্ছে। অথচ বকেয়া পরিশোধের কোনো লক্ষণ নেই।

এফডিসিতে মোট শুটিং ফ্লোর ছিল ৯টি। এর মধ্যে এফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য এফডিসির সাত একর জায়গার ওপর থাকা ৩, ৪, ৫ নম্বর শুটিং ফ্লোর ও এডিটিং ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাকি ফ্লোরগুলোতে শুটিং তেমন হয় না বললেই চলে। ৮ নম্বর ফ্লোরটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার কাছে ভাড়া দেওয়া আছে।

এফডিসির প্রশাসনিক ভবনের নিচ তলায় থাকা জহির রায়হান কালার ল্যাবটি ২০১০ সালের পর থেকে প্রায় কর্মশূন্য ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এফডিসি প্রশাসন জানায়, ওই সময় থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হওয়ায় ৩৫ মিলিমিটার পদ্ধতির এনালগ ফরমেটে মানে নেগেটিভে আর চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না বলে এই ল্যাবটি আর কোনো কাজে আসছে না। এদিকে এই ল্যাবের দামি মেশিনগুলো দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় এখন প্রায় নষ্টের পথে।

এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানায় পর্যাপ্ত আয় হারিয়ে এফডিসি রয়েছে বেহাল দশায়। কখনো এফডিআর থেকে লোন নিয়ে, কখনো সরকারি অনুদানে, কখনোবা সরকারি প্রণোদনায় অনেকটা ভিক্ষাবৃত্তির মতো করেই চলছে এফডিসি। অথচ বিদ্যুৎ, পানির বিল, উন্নয়ন কাজ,  দৈনন্দিন খরচসহ মাসিক খরচ ১ কোটি টাকারও বেশি। অথচ মাসিক আয় ৩০ থেকে ৬০ লাখ টাকার বেশি নয় বলে জানায় সংস্থাটির প্রশাসন।

এফডিসিতে চলচ্চিত্রের কাজ আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় ২০১০ সাল থেকে। তখন থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলে এফডিসিতে ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের টেকনিক্যাল সাপোর্ট না থাকায় নির্মাতারা প্রাইভেট সেক্টর ও দেশের বাইরে চলে যান ডিজিটাল চলচ্চিত্রের কারিগরি কাজের জন্য। এরপর এফডিসির আধুনিকায়ন প্রকল্প ২০১৮ সালের দিকে সম্পন্ন হলেও ক্যামেরা ও সম্পাদনা বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগে বিশেষ করে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ তখন চালু হয়নি। আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে এফডিসি চিহ্নিত করেছে দুটি বিষয়কে। সংস্থার কথায় এফডিসির আয়ের প্রধান খাত ছিল নেগেটিভ বিক্রি ও নেগেটিভ পরিস্ফুটন। এফডিসির আয়ের প্রধান উৎস ছিল ফিল্মের কাঁচামাল বিক্রি এবং কালার ল্যাবে ফিল্ম পরিস্ফুটন। এই দুই খাতের আয় দিয়েই বেতন, ভাতা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করে আরও অর্থ এফডিসির ফান্ডে জমা থাকত। ৩৫ মিলিমিটারের যুগ শেষ হয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির নির্মাণ শুরু হলে এই দুটি খাত বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এনালগ আমলে এই দুই খাত থেকে যে আয় হতো তা দিয়ে এফডিসির যাবতীয় খরচ মিটিয়ে আরও অর্থ জমা থাকত। বর্তমানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বাইরে চলচ্চিত্র নির্মাণে কারিগরি ও শুটিংয়ের বহু বেসরকারি ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় ওইসব সংস্থা লোভনীয় অফার দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে যায়। আর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কথায় এফডিসিতে বাইরের প্রাইভেট স্টুডিওর তুলনায় নির্মাণ খরচ বেশি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে এফডিসিতে আর যাই না। তাছাড়া এফডিসিতে কাজ করতে গেলে সেখানে জটিলতা বেশি থাকায় যথাসময়ে আমাদের আবেদন পূরণ করা হয় না বলে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ি। ফলে বাইরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। ডিজিটাল যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে আয়ের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকে থাকা সংস্থাটির এফডিআরের বিপরীতে ঋণ নিয়ে বেতন ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ হতো। একসময় তাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন থেকেই সরকারের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে চলতে থাকে সংস্থাটি। 

এফডিসি কর্তৃপক্ষ দুঃখের সঙ্গে জানায়, দেশের এই প্রধান গণমাধ্যমটি ২০১০ সাল পর্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। ২০১০ সালের পর ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলে এই দুই এনালগ খাতে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এফডিসি আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। থেমে যায় সংস্থাটির স্বাভাবিক গতি। এদিকে এফডিসির বেহাল দশা সম্পর্কে জানতে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর