সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক অভিনেতার গল্প

অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক অভিনেতার গল্প

প্রয়াত অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার সঙ্গে তাঁর কন্যা সুবর্ণা মুস্তাফা

দেশবরেণ্য কিংবদন্তি অভিনেতা প্রয়াত গোলাম মুস্তাফা। অভিনয়ে, কণ্ঠে তিনি ছিলেন অনবদ্য একজন। ছোট কিংবা বড়- দুই পর্দায়ই এবং মঞ্চে তাঁকে দেখতে মুখিয়ে থাকতেন দর্শক। এক জীবনে বহু চরিত্রে তিনি দাগ কেটেছেন সবার অন্তরে। গুণী এই অভিনেতাকে নিয়ে লিখেছেন -আলাউদ্দীন মাজিদ

 

অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা

গোলাম মুস্তাফা চিত্রজগতে আসেন প্রামাণ্যচিত্র ‘এক একর জমি’তে অভিনয়ের মাধ্যমে। প্রথম অভিনীত ছবি এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’। ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তিনি ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রটি ছিল জমিদারের। মূলত প্রথম ছবি থেকেই তিনি অভিনয়ে পারদর্শিতা দেখান। এরপর নায়ক, সহনায়ক, খলনায়কসহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া তিনি অনেক ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হারানো দিন’ ছবিতে মদ্যপ জমিদারের ভূমিকায় তাঁর অভিনয়ের কথা অনেকের স্মৃতিতে আজও অমলিন। ১৯৬৩ সালে ‘নাচঘর’ ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব হয়। ১৯৬৪ সালে প্রথম উর্দু ছবি ‘কাজল’-এ অভিনয় করেন। এরপর বেশ কয়েকটি উর্দু চলচ্চিত্রে কাজ করেন তিনি। গোলাম মুস্তাফা বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন।

 

মঞ্চনাটকে          

১৯৪৫ সালে বরিশাল অশ্বিনী কুমার টাউন হল মঞ্চে বি ডি হাবিবুল্লাহ রচিত ‘পল্লীমঙ্গল’ নাটকে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। পরিণত বয়সে ষাটের দশকের শুরুতে গোলাম মুস্তাফা নাট্যাভিনয় শুরু করেন। মঞ্চ, সিনেমা ও নাটক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। গোলাম মুস্তাফা অনেক বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন।

 

দক্ষ আবৃত্তিকার

আবৃত্তিকার হিসেবে তিনি দর্শকদের নজর কাড়েন। ১৯৪৫ সালে বরিশাল জিলা স্কুলে ‘ফাতেহা ইয়াজ দাহাম’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘ঐ নাম’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন ও দর্শক নজর কাড়েন। আমৃত্যু তাঁর দক্ষ আবৃত্তি দর্শকমনকে ভাব-আবেগে ভরিয়ে দিয়ে গেছে।

 

জনপ্রিয় লেখক

গোলাম মুস্তাফা একজন জনপ্রিয় লেখকও ছিলেন। বিভিন্ন সাময়িকীতে আধুনিক চলচ্চিত্র ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি কর্নেল মেইগস রচিত ‘ফেয়ার উইন্ড টু ভার্জিনিয়া’ গ্রন্থের সুপাঠ্য অনুবাদ করেন। ইউসিস, ঢাকা প্রকাশিত এ অনুবাদ গ্রন্থটির বাংলা নাম ‘নতুন যুগের ভোরে’। তাঁর অনেক অনুবাদকর্ম বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

 

বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে

গোলাম মুস্তাফা ঢাকা টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে নাটকে অভিনয় শুরু করেন। প্রথমদিকে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নাটকে নায়ক চরিত্রে ছিলেন। তিনি তাঁর সহকর্মী বেতারের অভিনেত্রী হোসনে আরার সঙ্গে ১৯৫৮ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের মেয়ে সুবর্ণা মুস্তাফা একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। গোলাম মুস্তাফা অভিনীত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটক হলো- ‘গুপ্তধন’, ‘অর্পিতা’, ‘হিতঙ্কর’, ‘পাথরে ফুটাবো ফুল’, ‘যুবরাজ’ ও ‘অস্তরাগে’।

 

যত সম্মাননা

গোলাম মুস্তাফা ১৯৮০ সালে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা এবং ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০০১ সালে এই কিংবদন্তি অভিনেতাকে চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক সম্মানে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তাঁকে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, তিনবার জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, দুইবার সাইট অ্যান্ড সাউন্ড চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার, সিনেমা চলচ্চিত্র পুরস্কার, জাতীয় টিভি পুরস্কার, আবদুল জব্বার খান স্বর্ণপদক, টেনাশিনাস পদক, মাবুবুল্লাহ জেবুন্নেসা কল্যাণ ট্রাস্ট স্বর্ণপদক, বরিশাল বিভাগ সমিতি শেরেবাংলা পদকসহ আরও বিভিন্ন পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়।

 

জীবন চিত্র

জনপ্রিয় অভিনেতা ও বিশিষ্ট আবৃত্তিকার গোলাম মুস্তাফা ১৯৩৪ সালের ২ মার্চ বরিশালের দপদপিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। স্কুলজীবন শুরু হয় পিরোজপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে। ম্যাট্রিক পাস করেন খুলনা জিলা স্কুল থেকে। স্কুল-কলেজ জীবনে নাটকে অভিনয় করা তাঁর শখ ছিল। ঢাকায় আসেন পঞ্চাশের দশকের মধ্যসময়ে। সেই থেকে তিনি ঢাকায় স্থায়ী হয়ে যান। একাধারে তিনি একজন অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, নাট্যকার ও আবৃত্তিকার। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, মঞ্চ ও বেতার- সর্বক্ষেত্রেই ছিল তাঁর সরব বিচরণ। অভিনয় করেছেন প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে। কখনো নায়ক, কখনো খলনায়ক, আবার কখনোবা পার্শ্বচরিত্রে সুঅভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন। মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক, বেতারের কণ্ঠ অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার হিসেবে দিয়েছেন দক্ষতার পরিচয়। পিরোজপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গোলাম মুস্তাফার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। ১৯৫০ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৫২ সালে দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। এরপর কিছুদিন শিক্ষকতা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পরপারে পারি জমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের কিংবদন্তি এই ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর