বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন নবাব

বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন নবাব

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি পাঁচ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। নায়ক চরিত্রে যেমন সফল ছিলেন, তেমনি জ্যেষ্ঠ ভূমিকায় এসেও ছড়িয়েছিলেন অভিনয়ের দ্যুতি। তিনি আনোয়ার হোসেন। যাঁকে ভালোবেসে দর্শক ও সিনেজগতের মানুষেরা বলেন, ‘মুকুটহীন নবাব’। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। সেই সিনেমা দিয়ে জয় করেছিলেন সবার মন। এরপর সবাই তাঁকে সিনেমার নবাব হিসেবে আখ্যা দেন। আজ বরেণ্য এই অভিনেতার মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সম্মাননায় তিনিই প্রথম

দর্শকের ভালোবাসা ও পুরস্কার দুটোতেই সমৃদ্ধ আনোয়ার হোসেনের প্রাপ্তির ঝুলি। তাঁর এমন দুটি অর্জন রয়েছে, যা আর কারও নেই; ভবিষ্যতে কারও পক্ষে পাওয়া সম্ভবও হবে না। তিনি দেশের প্রথম অভিনেতা, যিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় এই সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরও অনেকেই এই সম্মাননা পেয়েছেন, কিন্তু প্রথম অভিনেতা তিনিই। দ্বিতীয় অর্জন হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। রাষ্ট্রীয় এই পুরস্কারের প্রবর্তন হয় ১৯৭৫ সালে। সে বছরই শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান আনোয়ার হোসেন। অর্থাৎ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাসেও প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তিনি।

 

অভিনয় শুরুর গল্প

আনোয়ার হোসেনের অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল স্কুল জীবনেই। স্কুলে থাকতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন আসকার ইবনে সাইকের ‘পদক্ষেপ’ নাটকে। সে সময়ই একে একে অভিনয় করেছিলেন বেশ কয়েকটি মঞ্চনাটকে। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময়ও বাদ যায়নি তাঁর অভিনয় প্রতিভা। তাঁর অভিনয়সত্তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন সহপাঠী এবং শিক্ষকরাও।  কলেজ জীবনে মঞ্চনাটকে জড়িয়ে পড়েন আনোয়ার হোসেন। ১৯৫৭ সাল। জামালপুর ও ময়মনসিংহ ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন তরুণ আনোয়ার হোসেন। ঢাকা বেতারের ‘নওফেল হাতেম’ নাটকে মিলেছিল তাঁর প্রথম অভিনয়ের সুযোগ। যে বছর ঢাকায় এলেন, সে বছরই বিয়ে করেছিলেন তিনি। একই বছর চলচ্চিত্রকার মহিউদ্দিনের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দেন মহিউদ্দিনের সহকারী মোহাম্মদ আনিস। কথার এক ফাঁকে আনোয়ার হোসেনকে একপ্রকার যাচাই করে নেন মহিউদ্দিন। ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বিপরীতে আনোয়ার হোসেন পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৩০০ টাকা। তাঁর সাবলীল অভিনয় অনেকের নজরেই পড়ে। এর সুবাদে পরিচালক মহিউদ্দিন তাঁকে ‘তোমার আমার’ সিনেমায় কাজের সুযোগ দেন। ১৯৬১ সালের ওই সিনেমায় অবশ্য আনোয়ার হোসেনের চরিত্র ছিল ভিলেন। নায়ক চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিষেক হয়েছিল সালাহউদ্দিন পরিচালিত ‘সূর্যস্নান’ সিনেমার মাধ্যমে। এরপর অল্প সময়েই সিনেমা জগতে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। ষাটের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে আনোয়ার হোসেন অন্তত দেড় ডজন সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে তাঁকে আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৬৭ সালে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমায় অভিনয় করেই তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও সমান খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটবিহীন নবাব’ অভিধায় অভিষিক্ত হন। কোন ধাঁচের চলচ্চিত্রে নেই আনোয়ার হোসেন? ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, নাট্যধর্মী, লোককাহিনিভিত্তিক, পোশাকি ফ্যান্টাসি, সাহিত্যনির্ভর, শিশুতোষ, পারিবারিক মেলোড্রামা ও বক্তব্যধর্মী- সব চলচ্চিত্রেই ছিল তাঁর শীর্ষস্থান।

 

প্রথম ছবিতে খলনায়ক

জীবদ্দশায় নিজের অভিনয় জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘বালকবেলায় স্কুলের নাটকে অভিনয় করতে গিয়েই অভিনয়ের প্রতি আমার আসক্তি। এরপর তখনকার রুপালি জগতের তারকা ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী- তাঁদের বিভিন্ন ছবি দেখতে দেখতেই রুপালি জগতে আসার ইচ্ছাটি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। ৫০ দশকের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম অভিনয় করব সারা জীবন। সুতরাং অন্য কোনো জীবিকার সন্ধান না করে সরাসরি চলে গেলাম পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি তখন ‘মাটির পাহাড়’ নামে একটি সিনেমার কাজ করছিলেন। তাঁকে ধরলাম আমাকে নেওয়ার জন্য। তিনি জানালেন, ছবিতে অভিনয়শিল্পী নির্বাচনের কাজ শেষ। ফলে আমাকে নেওয়া যাচ্ছে না আপাতত। ৫৮ সালে শুরু করলেন ‘তোমার আমার’ সিনেমার কাজ। এখানে আমাকে নির্বাচন করা হলো খলনায়ক চরিত্রে। আমার রুপালি পর্দায় অভিষেক হলো ভিলেন হিসেবে।’

 

ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরানো ছবি

সালাহউদ্দিনের ‘সূর্যস্নান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি এলেন লাইমলাইটে।  কিন্তু তাঁর অভিনয় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল জহির রায়হানের বিখ্যাত ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রে দুর্র্ধর্ষ অভিনয়। যে চলচ্চিত্রে অনন্য শক্তিমান অভিনয় জানান দিল বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন নবাবের আগমন ঘটেছে। ১৯৬৭ সাল। মুক্তি পেল খান আতাউর রহমান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’। যে চলচ্চিত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। প্রতিকূলতার সাক্ষী সে সময়ে আনোয়ার হোসেন যেন হাজির হলেন স্বাধীনতার অবতার হয়ে। পুনর্জন্ম হলো যেন বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার। মানুষের আবেগ উথলে উঠল। যে চলচ্চিত্রে আমরা পর্দার নবাব সিরাজউদ্দৌলার তথা আনোয়ার হোসেনের গলায় পরাজয়ের মুখে শুনতে পাই ‘গোলাম হোসেন, আমি আবার সৈন্য সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব, এই জন্মে না পারি, জন্ম-জন্মান্তরে এই কলঙ্ক আমরা দূর করব’। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেন আবির্ভূত হন নতুনরূপে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় যিনি একবার দেখেছেন, তিনিই স্বীকার করতে বাধ্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুকুটহীন সম্রাট একজনই। এই চলচ্চিত্রের জন্য আনোয়ার হোসেন পেয়েছিলেন পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের বিখ্যাত নিগার পুরস্কার। পরের বছরই মুক্তি পেয়েছিল ‘সাত ভাই চম্পা’ চলচ্চিত্র। ‘সুলেমানপুরের বাদশাহ’ চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় ছিল চিরন্তন মুগ্ধতার। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জীবন থেকে নেয়া’কে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলা হয়। যে চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন অভিনয় করেছিলেন সচেতন জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতার চরিত্রে। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। এই চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দাগ কেটে গেছে কোটি মানুষের মনে। আনোয়ার হোসেন অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে। ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ‘ভাত দে’র মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে তাঁর হৃদয়গ্রাহী অভিনয় এখনো দর্শকমুগ্ধতায় ভাসছে। ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র ছিল বিশ্বখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত কোনো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন অভিনয় করেছিলেন ‘সাইজুদ্দিন বয়াতি’ চরিত্রে।

 

যত সম্মাননা

খ্যাতিমান অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় কর্মের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন সংগঠনের দেওয়া পুরস্কার ও সম্মাননা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলো- ১৯৬৭ সালে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ‘নিগার পুরস্কার’, ১৯৭৫ সালে ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ১৯৭৮ সালে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ও ১৯৮৭ সালে ‘দায়ী কে?’ ছবির জন্য পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। ১৯৮৮ সালে অর্জন করেন ‘একুশে পদক’। এছাড়াও একাধিকবার বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ২০১০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন।

 

নিজেই নিজের চরিত্রে

আনোয়ার হোসেনই একমাত্র অভিনেতা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে, যিনি নিজেই নিজের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন- ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ছবিতে, অভিনেতা আনোয়ার হোসেন চরিত্রে। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো ধারণাই করতে পারবে না যে, কত উঁচুমাপের অভিনেতা ছিলেন, কত জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন আনোয়ার হোসেন। একসময় পারিবারিক-সামাজিক ছবির একচ্ছত্র প্রতাপশালী অভিনেতা ছিলেন তিনি। চরিত্রাভিনেতা হয়েও তাঁর চাহিদা ছিল নায়কদের চেয়েও বেশি। তখন তাঁর সঙ্গে জুটি হিসেবে ছিলেন আরেক প্রখ্যাত অভিনেত্রী রোজী। তাঁরা দুজন ছবিতে থাকা মানে সেই ছবি দর্শক চাহিদায় এক নম্বরে, ছবি হিট-সুপারহিট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সর্বকালের সেরা অভিনেতা বলা যেতে পারে তাঁকে। একজন আনোয়ার হোসেন যুগে যুগেও জন্ম নেয় না কোনো দেশে। এমন একজন আনোয়ার হোসেন আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে আর জন্মাবে কি না, সন্দেহ আছে। আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ নভেম্বর জামালপুরের মুরুলিয়া গ্রামে।

সর্বশেষ খবর