মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই বেহুলা সুচন্দার গল্প...

সেই বেহুলা সুচন্দার গল্প...

জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবির কথা মনে পড়লেই আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে  বেহুলারূপী সুচন্দার মুখ। আজ এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

চলচ্চিত্র জীবনের শুরু...

পুরো নাম কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। ১৯৬৪ সালে প্রখ্যাত অভিনেতা কাজী খালেকের একটা প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম কাজ তাঁর। সুভাষ দত্ত পরিচালিত কাগজের নৌকা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। ১৯৬৭ সালে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’ নির্মাণ করেন জহির রায়হান। এতে অভিনয়  করে তিনি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান। এরপর তাঁর দর্শকপ্রিয় অগণিত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হ্ন্ডেচ্ছ- জীবন থেকে নেয়া, চাওয়া পাওয়া, কুচবরণ কন্যা, নয়নতারা, সুয়োরানী দুয়োরানী, যে আগুনে পুড়ি, মনের মতো বউ, কাঁচের স্বর্গ, অশ্রু দিয়ে, বিচার প্রভৃতি। তাছাড়া পাকিস্তানের বেশ কটি ছবিতে অভিনয় করেন ও সেখানে পুরস্কৃত হন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন।

তাঁর স্বামী জহির রায়হানের জীবদ্দশায় টাকা আনা পাই ও প্রতিশোধ চলচ্চিত্র দুটি প্রযোজনা করেন। এছাড়াও তিন কন্যা, বেহুলা লখিন্দর, বাসনা ও প্রেমপ্রীতি চলচ্চিত্রগুলো প্রযোজনা করেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘সবুজ কোট কালো চশমা’। ২০০৫ সালে স্বামী জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং সেরা প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর চলচ্চিত্রের অবস্থা মন্দ হতে শুরু করলে চরম ক্ষোভ নিয়ে এই জগৎ থেকে দূরে সরেন তিনি।

 

জন্ম ও পরিবার

সুচন্দার জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সাল। যশোরের বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা এ এস এম নিজামউদ্দীন আইয়ুব ও মাতা চিকিৎসক বেগম জাহান আরা। সুচন্দার সন্তানরা হলেন- আরাফাত রায়হান, তপু রায়হান, রাফাইয়াৎ মালিক, রাফাইয়া মালিক। তাঁর ছোট বোন ববিতা ও চম্পা ঢালিউডের দুই অভিনেত্রী। অভিনেতা রিয়াজ তাঁর চাচাতো ভাই।

 

অভিনয় জীবনের মজার স্মৃতি...

অভিনয় জীবনের গল্প বলতে গিয়ে সুচন্দা জানালেন তাঁর প্রথম অভিনীত ছবির কথা। তিনি বলেন, ১৯৬৬ সাল। প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা সুভাষ দত্ত আমাকে নিয়ে নির্মাণ করছেন ‘কাগজের নৌকা’ ছবিটি। চলচ্চিত্রে আমার প্রথম অভিনয়। ক্যামেরাসহ নির্মাণের অনেক ভাষাই ছিল আমার অজানা। চিত্রায়ণ চলছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো আমি। সুভাষ দা লাইটম্যানকে বারবার বলছেন ওর চুলটা আরেকটু কাট... আরেকটু কাট...! আমি তো ভয়ে অস্থির, আমার এত সুন্দর লম্বা চুল কেটে ফেলবে। সুভাষ দাকে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছি না। ততক্ষণে চোখে অশ্রু জমে গেছে। শর্ট শেষ হলে দেখলাম কই চুল তো কাটা হয়নি। সুভাষ দার কাছে কাটাকাটির বিষয়টি জানতে চাইলে হেসে উঠে তিনি বললেন, ‘ধুর বোকা মেয়ে, ধীরে ধীরে সব বুঝবি’।

সেদিনের সেই কথা মনে পড়লে আজও আপন মনে হেসে ওঠি। এরপর ১৯৬৮ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করলাম। এটি নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম অভিনয়। ছবিটি বাম্পার হিট হয়ে গেল। এরপর আমি আর রাজ্জাক জুটি হয়ে বহু ছবিতে অভিনয় করলাম। সবই দর্শকনন্দিত হলো। আমাদের জুটির চাহিদা এতটাই বেড়ে গেল যে, তৎকালীন পাকিস্তানি চলচ্চিত্র প্রযোজকরাও আমাদের নিয়ে কাজ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাঁদের কথায়- ‘যেতনা চাহেগা হাম দেঙ্গে, লেকেন সুচন্দা আওর রাজ্জাককো হামারি পিকচারমে চাইয়ে...।’

 

জহির রায়হানের উৎসাহে নির্মাণে...

সুচন্দা বলেন, ‘জহির রায়হান সব সময় আমাকে বলতেন নির্মাণে আসার জন্য। আমার কথা ছিল নির্মাণ একটি কঠিন কাজ। এর জন্য প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় দরকার। তাই তখন রাজি হলাম না। তবে দুটি ছবি প্রযোজনা করেছিলাম। এগুলো হলো- ‘টাকা আনা পাই’ এবং ‘প্রতিশোধ’। দুটি ছবিই ব্যবসাসফল হল।’ এরপর তিন কন্যাসহ আরও বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করলাম। মূলত জহিরের উৎসাহ আমাকে নির্মাণে আসতে সহায়তা করেছিল।

 

‘তিন কন্যা’ নির্মাণের নেপথ্যে...

১৯৮৫ সালে মুক্তি পেল সুচন্দা প্রযোজিত ‘তিন কন্যা’ ছবিটি। সুপারহিট এই ছবিতে সুচন্দা আর তাঁর দুই বোন ববিতা আর চম্পা প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। আর এ ছবির মাধ্যমেই অভিনয়ে এসেছিলেন চম্পা। ছবিটি নির্মাণের নেপথ্যের কথা জানাতে গিয়ে সুচন্দা বলেন, আমার বাবা তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে অসুস্থ অবস্থায় প্রায় আমাকে ডেকে বলতেন, তুমি একটি ছবি নির্মাণ কর। তাতে তোমরা একসঙ্গে তিন বোন অভিনয় করবে। একসময় বাবা মারা গেলেন।

বাবার ইচ্ছা কখন পূরণ করব এই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। শুটিং, যে কোনো কাজের মধ্যে কিংবা ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও কাগজ কলম সঙ্গে রাখতাম। এটি অবশ্য আমার পুরনো অভ্যাস। জহির রায়হান তাঁর ছবির গল্প মনে পড়লেই আমাকে তা বলতেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমি তা লিখে ফেলতাম।

এমনকি আমি ঘুমিয়ে পড়লেও তাঁর যদি গল্পের কথা মনে পড়ত আমাকে ডেকে তুলতেন লেখার জন্য। আমি ঘুমঘুম চোখে বালিশের নিচে রাখা কাগজ কলম বের করে লেখা শুরু করে দিতাম। ঠিক তেমনি করেই ‘তিন কন্যা’ ছবির গল্প লেখা হলো। এতে তিন কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করি আমরা তিন বোন।

সর্বশেষ খবর