রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিমানবন্দরে গিয়ে জানলাম ওয়াহিদ আর নেই : ববিতা

আলাউদ্দীন মাজিদ

বিমানবন্দরে গিয়ে জানলাম ওয়াহিদ আর নেই : ববিতা

‘২০০৪ সাল’, আমার অভিনীত ‘বন্দিনী’ ছবির নায়ক ওয়াহিদ কাদির আমাকে ফোন দিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি আমার বিপরীতে এ ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক নজর কাড়েন। ছবিটি মুক্তির আগেই ওয়াহিদ তার জন্মস্থান আফগানিস্তানে ফিরে যান। এরপর তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আমার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তার কল পেয়ে আমি অবাক হলাম। অনেক কষ্টে নাকি আমার নাম্বার জোগাড় করেছিলেন তিনি। অনেক কথার মধ্যে আমাকে তিনি জানান বন্দিনী ছবিটির কথা। তিনি বললেন ছবিটি তার দেখা হয়নি। ছবিটি কোনোভাবে তাকে দেখানোর ব্যবস্থা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন তিনি। পরে আমি অনেক কষ্টে ছবিটি ডিভিক্যাম ফরমেটে জোগাড় করে তাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিই। ওয়াহিদ জানিয়েছিলেন, ওই সময়টাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকবেন। আমারও ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা। ভাবলাম ওখানে গিয়ে তার হাতে ছবিটি তুলে দেব, দেখাটাও হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকা এয়ারপোর্টে গিয়ে তাকে ফোন দিলাম, তাকে জানাতে চাইলাম আমি আসছি। কে একজন ফোন রিসিভ করে বললেন, তিনি তো নেই, কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। কথাটি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভীষণভাবে মুষড়ে পড়লাম। অনেক শখ থাকা সত্ত্বেও ওয়াহিদ নিজের অভিনীত একমাত্র ছবিটি আর দেখে যেতে পারলেন না। হায়রে নিয়তি। এরপর ববিতা ছবিটি এবং ওয়াহিদ সম্পর্কে বলেন, ‘ইশারায় শিস্ দিয়ে আমাকে ডেকো না...’ এই জনপ্রিয় গানটির কথা এখনো হয়তো অনেকের কানে গুনগুনিয়ে বেজে ওঠে, শুনে আক্রান্ত হন নস্টালজিয়ায়। এটি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম নির্মিত ‘বন্দিনী’ ছবির একটি গান। ছবিটি অবশ্য এহতেশাম তার পুত্র মুশতাককে দিয়ে পরিচালনা করান। ছয় ফুট লম্বা ২২ বছরের সুদর্শন আফগান যুবক বাংলাদেশে এসেছেন রাষ্ট্রদূত বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাংলাদেশে এসেই সেই যুবক শুরু করেন মডেলিং। পরিচালক এহতেশামপুত্র মুশতাক ছবি নির্মাণ করবেন। ছবির নাম ‘বন্দিনী’। এ ছবির জন্য এমন একজনকে খুঁজছিলেন যাকে দেখলে মনে হবে আমেরিকা ফেরত। আফগান যুবক ওয়াহিদকে প্রথম দেখাতেই মনে ধরে পরিচালকের। ওয়াহিদ বাংলাদেশের ছবিতে এসেছিলেন ধূমকেতুর মতো- আবার হারিয়েও যান একইভাবেই। বন্দিনী সিনেমার পর ওয়াহিদ আর অভিনয় করেননি। ১৯৫৪ সালে কাবুলে জন্ম নেওয়া ওয়াহিদ কাদির রাষ্ট্রদূত বাবার কল্যাণে ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। পশতু, ইংরেজি, ফারসি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও রপ্ত করেছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালে ওয়াহিদ যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন। সেখানে সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ড হিসেবে নিজের শ্রম এবং মেধার স্বাক্ষর রাখেন ওয়াহিদ। ১১ বছরের মাথায় ১৯৯১ সালে আরেকটি সিকিউরিটি কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। পরে ১৯৯৭ সালে নিজেই শুরু করেন সিকিউরিটি বিজনেস। ২০০১ সালে ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামলে তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েন ওয়াহিদ। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে যান। স্ত্রী ও তিন ছেলের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে থাকেন তিনি। একসময় তার স্ত্রী রোনা আর বড় ছেলে ম্যাথিউ ক্লায়েন কাদির সংসার চালাতে চাকরি নেন। পরে ওয়হিদ নিজেও আবার নতুন করে কোম্পানি শুরু করেন। ওয়াহিদের দুঃসময়ে তার ধনাঢ্য পরিবার তার পাশে দাঁড়ায়নি। ২০০৩ সালে ওয়াহিদ কাদিরের মা আফগানিস্তানে তাদের পারিবারিক বিশাল সম্পত্তি তিন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে ছোট ছেলেকে ব্যবসার জন্য টাকা দেন। কিন্তু নির্মমভাবে বঞ্চিত করেন বড় ছেলে ওয়াহিদকে! এ ঘটনায় ওয়াহিদ ভীষণ মর্মাহত হন। অর্থাভাবে ওয়াহিদ তার বিশাল সুইমিংপুলওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে ছোট্ট দুই রুমের অ্যাপার্টমেন্টে উঠেন। ক্রমশ বিষাদে ডুবতে থাকা ওয়াহিদ একসময় জীবনের কাছে হার মানেন। অসম্ভব অভিমান নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্দেশে লিখে যান তার শেষ চিঠি। চিঠিতে তিনি লিখেন- ‘আমি কারও মাথাব্যথার কারণ হতে চাই না। আমার দেহটি তোমরা পুড়িয়ে দিও। আমি অলরেডি দরদাম দেখে রেখেছি। মাত্র ৮০০ ডলার লাগবে! আমাকে কবর দিতে যেও না, অনেক খরচের ব্যাপার। আমি তোমাদের আর কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই না! আমার স্ত্রী আর তিন সন্তানকে আমি অনেক ভালোবাসি, কিন্তু আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।’ হতাশাগ্রস্ত ওয়াহিদ কাদির ২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।

সর্বশেষ খবর