মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বর্ণালি যুগের সেই মায়াবী অভিনেত্রী

স্বর্ণালি যুগের সেই মায়াবী অভিনেত্রী

ঢাকাই চলচ্চিত্রের একসময়কার অন্যতম দাপুটে অভিনেত্রী তিনি। কখনো নায়িকা, কখনো বড় ভাবি, মা কিংবা বিধবা চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন সিনেপ্রেমীদের। নানা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়শৈলীতে সবার মন জয় করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী রোজী আফসারী। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

মায়াবী চেহারার মা

‘আগে পিছে কত মানুষ যাবে সাথী হইয়া, হাসিমুখে মা রবে দুয়ারে দাঁড়াইয়া, দুয়ারে দাঁড়াইয়া দোয়া দেবে, মায়েরও দোয়াতে দুঃখ যাবে’-

‘বন্ধু’ ছবিতে ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাব’ গানে নায়করাজ রাজ্জাক ও উজ্জ্বল দুই বন্ধু মিলে মা রোজী আফসারীকে গানে গানে এ কথাগুলো বলে। নায়করাজের মায়ের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়া ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘আলোর মিছিল’ ছবিগুলোতে ছিল ভাবির চরিত্রে। তিনি যে একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়শিল্পী ছিলেন এতেই বোঝা যায়। সেই রাজ্জাক থেকে সালমান শাহ পর্যন্ত তিনি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তিতে এসব মাইলফলক। রোজী আফসারীকে বলা হয় ঢালিউডের সবচেয়ে মায়াবী চেহারার মা। আশির দশকে বহু ছবিতে রোজী আফসারী মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

 

অভিনয়ের শুরু

প্রকৃত নাম শামীমা আক্তার রোজী। তিনি ১৯৬২ সালে অভিনয় জীবন শুরু করেন এবং ২০০৫ সালে তাঁর অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘পরম প্রিয়’ মুক্তি পায়। অভিনেত্রী রোজী ১৯৬২ সালে আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘জোয়ার এলো’ ছবির মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন। তবে তিনি জনপ্রিয়তা পান নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে অভিনয় করে। শুরুর দিকে জাঁদরেল ঘরনি চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়েছিলেন রোজী। এরপর তাঁর কোমল, মোহনীয় রূপে মাতাল করেছেন সব বয়সী পুরুষকে। মোহিত করেছেন নারীদেরও। সংগ্রামী নারীর প্রতিভু চরিত্রে রোজী এক বিস্ময়।

 

গুগল প্রকাশ করল ডুডল

২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল ছিল প্রয়াত অভিনেত্রী রোজী আফসারীর ৭৩তম জন্মদিন। দিনটিকে স্মরণীয় করে দিল ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল। তাঁর জন্মদিনে গুগল প্রকাশ করল ডুডল। সার্চ ইঞ্জিন গুগল তার হোমপেজে একটি নতুন ডুডল তৈরি করল, বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র অভিনেত্রী রোজী আফসারীকেই গুগল এই সম্মান জানিয়েছে। ওই বছরের ২২ এপ্রিল রাত ১২টার পর থেকেই চোখে পড়েছে বিশেষ এই ডুডল। গুগলে ঢুকতেই দেখা গেছে, হাস্যোজ্জ্বল প্রখ্যাত এই অভিনেত্রীর মুখ। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে বেশ পরিপাটি দেখা গেছে তাঁকে। চুলের খোঁপায় গুঁজে দেওয়া ফুল। বাংলা ও উর্দু সিনেমায় অভিনয় করেছেন প্রখ্যাত এই অভিনেত্রী। সেটি বোঝাতে জন্মদিন বাংলা ও উর্দু হরফে লেখা হয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে ৩৫০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

 

চলচ্চিত্র নির্মাণ

রোজী আফসারী নিজের চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রোজী ফিল্মসের ব্যানারে অসংখ্য ছবি প্রযোজনা করেছেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রোজী আফসারী। সে বছর রোজীর পরিচালনায় মুক্তি পায় চলচ্চিত্র ‘আশা-নিরাশা’।

 

নৃত্য পরিচালনা ও সম্মান

অভিনয় ক্যারিয়ারের পাশাপাশি বেশ কিছু ছবিতে তিনি নৃত্য পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। লন্ডন, সুইডেন, মিসর, সিরিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন রোজী আফসারী। ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন রোজী। তিনি ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জিয়া স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, বাচসাস, পূর্বাণী চলচ্চিত্র, এফডিসির রজতজয়ন্তী, কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড, স্বদেশ সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, অনির্বাণ সংসদ স্বাধীনতা পদক, মহিলা চিত্রপরিচালক হিসেবে সিডাব, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিগার’সহ দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০টি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

 

বালিকা হয়েও চল্লিশোর্ধ্ব নারীর চরিত্রে

কাজী জহিরের ‘বন্ধন’ ছবিতে মাত্র ১৪-১৫ বছরের বালিকা রোজী চল্লিশোর্ধ্ব নারীর চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন। ছবিটির জন্য গ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড ও স্ক্রিন নাইট অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। এই পুরস্কার দুটি পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) কোনো শিল্পীর জন্য প্রথম ছিল।

 

 

টিভি নাটকে

টিভি নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৬৮ সালে আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘সংশপ্তক’ নাটকে হুরমতি চরিত্রে ও ‘শাহজাহান’, ‘পদ্মগোখরা’ নামের দুটি নাটকে অভিনয় করেন।

 

সামাদ থেকে আফসারী

রোজী চিত্রগ্রাহক আবদুস সামাদকে ১৯৬৫ সালে বিয়ে করেন। এরপর তিনি রোজী সামাদ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯৮৭ সালে পরিচালক মালেক আফসারীকে বিয়ে করেন এবং নামের শেষে যোগ হয় আফসারী।

 

শেষবারের মতো চকলেট খেলেন

রোজী আফসারী দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ চার বছর এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে ২০০৭ সালের ৯ মার্চ মাত্র ৫৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান কিংবদন্তি ও জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী।

রোজী আফসারীর শেষ স্মৃতির গল্পে মালেক আফসারী জানিয়েছেন, ‘চকলেট রোজীর খুব প্রিয় ছিল। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও চকলেট খাওয়ার বায়না ধরেছিল রোজী। তখন সাড়ে ৩টার মতো হবে। বারডেম হাসপাতালের নিচ থেকে দুই টাকার চকলেট আনালাম। কামড়ে এক টুকরা তাঁর গালে দিয়েছিলাম। আর ১৫ মিনিট পর রোজী মারা গেল...।’ শেষ হয়ে গেল বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অধ্যায়ের।

সর্বশেষ খবর