শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভারতের ‘ডটার অব দ্য নেশন’

ভারতের ‘ডটার অব দ্য নেশন’

উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল ভারতরত্ন খেতাবপ্রাপ্ত গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন। ভক্ত-অনুরাগীরা পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করছেন। ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি অমৃতলোকের উদ্দেশে অনন্ত যাত্রা করেন। তবে তিনি তাঁর গানের সুর দিয়ে সবার অন্তরে বিরাজ করছেন।  সাত দশকেরও বেশি সময় সুমিষ্ট কণ্ঠ দিয়ে গানের ভুবন জয় করে রাখা এই মহান শিল্পীকে ভারত সরকার ‘ডটার অব দ্য নেশন’ উপাধিতে সম্মানিত করেছে। মহান এই শিল্পীর আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ডটার অব দ্য নেশন

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরকে ভারতের ‘ডটার অব দ্য নেশন’ উপাধিতে সম্মানিত করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। ২০১৯ ‘এশিয়ার নাইটিঙ্গেল’ খ্যাত এই মহান শিল্পীর ৯৪তম জন্মদিনে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় সংগীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়ানো লতা মঙ্গেশকরকে এই সম্মানে ভূষিত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পীকে অনেক আগেই ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘অফিসার দে লা দি’ অনার প্রদান করেছে সে দেশের সরকার। ৩৬টি ভাষায় ৫০ হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দেওয়া এই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি ১ হাজারের বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন। এ ছাড়া ভারতের ২০টি আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তাঁরই। বাংলাতেও তিনি অনেক গান করেছেন। ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্ন পাওয়া তিনিই দ্বিতীয় সংগীতশিল্পী। তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ রয়েছে তিনটি জাতীয় পুরস্কার, ১২টি বাঙালি ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার এবং চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। শেষে অবশ্য তিনি আর ফিল্ম ফেয়ার নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু পুরস্কার নয়, ১৯৬৯ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ আর ২০০১ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে লতা অর্জন করেন ‘ভারতরত্ন’ খেতাব।

 

হেমা থেকে লতা

ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বীননাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘরে এলো তাদের প্রথম সন্তান। নাম রাখলেন হেমা। দ্বীননাথের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন সেবন্তী। পতি দ্বীননাথ নিজেও সংগীত আচার্য ছিলেন। সংগীত ও নাটক- ‘ভাউবন্ধন’ নামের এক নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র লতিকাকে খুব মনে ধরেছিল দ্বীননাথ-সেবন্তী দম্পতির। তাই সন্তানের নাম হেমা থেকে বদলে রাখা হলো লতা।

 

যেভাবে গানের ভুবনে

 শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তাঁর। বাবা চাইতেন ও শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তাঁর বয়স ১৮। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাঁকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে. এল. সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। লতার বয়স তখন কেবল ১৯। সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দার তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শশধর মুখার্জির সঙ্গে। মুখার্জি তখন শহীদ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রটি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি মেয়েটির গান শুনে ‘বেশি চিকন গলা, এমন কণ্ঠ প্লেব্যাকের জন্য নয়’ বলে বাতিল করে দিলেন। বিরক্ত রাগান্বিত হায়দার বলে বসলেন, ‘একদিন পরিচালকেরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে তাঁকে তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে’। সেদিন কে জানত, এই ভবিষ্যদ্বাণী অতি দ্র“তই সত্য হবে। কথিত আছে প্রতিদিন ছোট বোন আশা ভোঁসলেকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করলে রাগ করে সেই স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেন তিনি।  দ্বীননাথ নিজের বাসাতেই অনেক ছাত্রকে গান শেখাতেন। একদিনের ঘটনা, অল্প কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেছেন দ্বীননাথ। এক ছাত্রকে বলে গেছেন গানের অনুশীলন করতে। ফিরে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন ছোট্ট লতা তাঁর ছাত্রের গানের রাগ শুধরে দিচ্ছেন। তারপর থেকেই বাবার কাছে লতার তালিমের শুরু। বসন্ত যুগলকরের ‘আপ কি সেবা ম্যায়’ চলচ্চিত্রে ‘পা লাগো কার জোরি’ গানটি তাঁর প্রথম হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে গাওয়া।

বিনায়কের মৃত্যুর পর সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দার হন লতার গুরু। ৮৪তম জন্মদিনে তিনি বলেছিলেন, গুলাম হায়দার তাঁর জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন। গুলাম হায়দারের হাত ধরে তাঁর জীবনে সুযোগ এলো ‘মজবুর’ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’ গানটি গাওয়ার। এই এক গানেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নতুন এই গায়িকাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। জীবনের প্রথম বড় ধরনের হিট নিয়ে আসে ‘মহল’ (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। এ গানে ঠোঁট মেলালেন মধুবালা। সেই তো সবে শুরু। তারপর শত শত গানে আপ্লুুত করেছেন লাখো মানুষকে। ষাটের দশকে উপহার দিলেন ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’ এর মতো তুমুলভাবে বিখ্যাত সব গান।

 

অভিনয়ে

পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অংশগ্রহণ করতেন লতা। একদিন দ্বীননাথের নাটকে নারদ মুনির চরিত্রের অভিনেতা কোনো কারণে এসে পৌঁছাননি। তাঁর আবার গানও গাওয়ার কথা। লতা বাবাকে এসে বললেন, তিনি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। প্রথমেই দ্বীননাথ তাঁর প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। ওই অতটুকু নারদ মুনিকে দেখতে যদি জোকার লাগে? লতার পীড়াপীড়িতে শেষটায় রাজি হলেন। লতার অভিনয় আর গান শেষে দর্শকরা ‘আবার চাই আবার চাই’ বলে চিৎকার করেছিল সেদিন।

পিতার ছায়া খুব বেশিদিন থাকেনি মঙ্গেশকর পরিবারের ওপর। লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন (১৯৪২ সাল) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সী লতার ওপর। পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাঁকে গান আর অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে শেখালেন। মাস্টার বিনায়ক তাঁর চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’ এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য ছোট একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। এ চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন তিনি। তখনো চলছে তাঁর জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ। চলচ্চিত্রের জীবনকে কখনো আপন করে নিতে পারেননি তিনি। একদিন কাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানান, এই কৃত্রিম অভিনয়ের জগৎ তাঁর আর ভালো লাগে না। লতা মঙ্গেশকর ১৩ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে প্রথম চলচ্চিত্র ‘মঙ্গলাগোরে’ অভিনয় করেছিলেন এবং কিছু সিনেমাতে তিনি নায়ক-নায়িকার বোনের ভূমিকাতেও অভিনয় করেছিলেন।  প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘লাভ ইজ ব্লাইন্ড’ সিনেমায়। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আটটি এবং তারপর মাত্র একটি গানের দৃশ্যের জন্য একটি ছবিতে অভিনয় করেন এই কিংবদন্তি।

 

বিশ্ব রেকর্ড

১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করার জন্য তাঁর নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পায়। এ সময় তিনি প্রায় ৩০ হাজার গান রেকর্ড করেছিলেন।

সর্বশেষ খবর