শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নারীপ্রধান চলচ্চিত্রের খরা

আলাউদ্দীন মাজিদ

নারীপ্রধান চলচ্চিত্রের খরা

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সংস্কৃতি জগতে চলচ্চিত্রে নারী অপরিহার্য অংশ। বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে নব্বই দশক পর্যন্ত নারীপ্রধান চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। একাত্তরপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব ছবি নির্মাণ হয়েছে তাতে নারীর অবদান এবং নির্যাতনের চিত্র সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতারা। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একটি নারীপ্রধান ছবি। এ ছবির স্লোগানই ছিল- ‘লাঞ্ছিত নারীত্বের মর্যাদা দাও, নিষ্পাপ সন্তানদের বরণ কর...’। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’। এ ছবিতে রাত্রি চরিত্রটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন এক সহজ-সরল মেয়ে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে সাহসী হয়ে ওঠেন তা দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে নারীপ্রধান ছবির ক্ষেত্রে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন। সত্তর থেকে তিনি নির্মাণ করেন নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, দুই পয়সার আলতা, সখিনার যুদ্ধ, গোলাপী এখন ঢাকায়, গোলাপী এখন বিলেতে প্রভৃতি। আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেন নারীপ্রধান চলচ্চিত্র সারেং বৌ; চাষী নজরুল ইসলামের শাস্তি ও সুভা; আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যা; সুচন্দার তিন কন্যা ও হাজার বছর ধরে; ববিতার ফুলশয্যা ও পোকা-মাকড়ের ঘরবসতি, মিতার আলোর মিছিল, হারুনূর রশিদের মেঘের অনেক রং; কাজী হায়াতের আম্মাজান, ধর, তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোসনা, নার্গিস আক্তারের চার সতীনের ঘর, মেঘের কোলে রোদ, মেঘলা আকাশ, অবুঝ বউ, পুত্র এখন পয়সাওয়ালা, পৌষ মাসের পিড়িত, যৌবতী কন্যার মন, মৌসুমীর মেহের নিগার, জয়ার দেবী, চয়নিকা চৌধুরীর বিশ্বসুন্দরী, তানিম রহমান অংশুর ন ডরাই প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে সূর্যদীঘল বাড়ি, বিরাজ বৌ, পালাবি কোথায়, নিরন্তর, গেরিলা, মায়াবতী, সুতপার ঠিকানার মতো নারীবাদী ছবি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা সব সময়ই উপেক্ষিত। নারীদের আনন্দ-বঞ্চনা নিয়ে ছবি নির্মাণ নারীদের হাতেই যথাযথভাবে ফুটে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ কম। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ বলেন, ঢালিউডে নারীপ্রধান চরিত্র নিয়ে ছবি নির্মাণ তেমনভাবে হয়নি। কারণ সমাজে নারীদের বিচরণ ও কর্ম ছিল সীমিত। সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণও কম ছিল। আগে নারীদের ভাবা হতো শুধুই ‘গৃহবধূ’। তাঁরা চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি থাকবে এমনই ছিল মানসিকতা। এখন সময়ের বিবর্তনে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছেন নারী প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। তাছাড়া নানা সেক্টরে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে। নারীদের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে, তাই এখন সময় এসেছে নারীপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণের। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও নির্মাতা ববিতা বলেন, নারী হিসেবে আমি যখন ছবি নির্মাণ করি তখন তাতে নারীদেরই প্রাধান্য দেই। অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর নির্মাতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কম বলেই বর্তমান সময়ে নারীপ্রধান ছবি নির্মাণ তেমনভাবে আর হয় না। আসলে ‘নারী ও পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক’- এ ভাবনাটি যতক্ষণ পর্যন্ত দেশ ও সমাজে প্রতিষ্ঠা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নারী অবহেলিতই থেকে যাবে। প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা নার্গিস আক্তারের কথায়- নারীরা বেশির ভাগই পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে থাকে। তাই একজন পুরুষ নির্মাতা যখন নারীপ্রধান নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যান তখন তারা তাদের এ দুর্বল অবস্থানকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার সাহস পান না। ফলে নারীদের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-বঞ্চনার কথা অপূর্ণই থেকে যায়। তাই নারীদের কথা নারীদেরই তুলে ধরতে হবে। অভিনেত্রী মৌসুমীর কথায় ‘নারীপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে একজন নারীর জীবনের পারিপার্শ্বিকতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের সমাজে নারীকে পদে পদে দুর্ভোগে পড়তে হয়। সংসার বা কর্মক্ষেত্র, সব জায়গায় একই অবস্থা। বর্তমানে এ বিষয়টি চলচ্চিত্রে তুলে ধরার মতো গল্প বা সাহসের অভাব রয়েছে বলেই নারীপ্রধান ছবি নির্মাণ কমে গেছে। এক্ষেত্রে নারীরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে।’ অভিনেত্রী জয়া আহসান বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রে নারী অবয়ব বেশির ভাগ সময়ই অস্পষ্ট ছিল। কিছু নারীকেন্দ্রিক ভালো কাজ যে হয়নি, তা নয়। হয়েছে, কিন্তু তা সংখ্যায় খুবই কম। বিশ্বজুড়ে নারীকেন্দ্রিক ছবি নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আমরা বেশির ভাগ ছবি দেখি পুরুষপ্রধান। এর মূল কারণ হতে পারে নির্মাতাদের ভাবনা। অনেকে ধরেই নেন, নারীপ্রধান চরিত্রের ছবিগুলো দর্শক সেভাবে গ্রহণ করবে না, কিংবা বাণিজ্যিক সফলতা পাবে না। এ ধারণা সব সময় সত্য বলে প্রমাণ হয়নি। গেরিলা ছবির কথাই বলি, যেখানে বিলকিস নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ওই ছবি ও আমার চরিত্র দর্শক ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, দর্শকের রুচি তৈরিতে গল্প ও চরিত্র কতটা ভূমিকা রাখে। তাই এ দেশে নারীপ্রধান ছবি নির্মাণের বিষয়ে একটু আলাদা করে ভাবার সময় এসেছে।’

সর্বশেষ খবর