রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
মঞ্চ নাটকের সূতিকাগার

জৌলুস হারিয়েছে বেইলি রোড

মোস্তফা মতিহার

জৌলুস হারিয়েছে বেইলি রোড

নাট্যকর্মীদের মননে মিশে আছে বেইলি রোড। বেইলি রোড আর নাটকের ইতিহাস একে অন্যের পরিপূরক। দুঃখজনক হলেও সত্য শিল্পী-কলাকুশলী আর দর্শকদের পদচারণে জমজমাট হয়ে ওঠা বেইলি রোড তথা নাটক সরণি তার ঐতিহ্য ও জৌলুস হারিয়েছে। দিনে দিনে বাণিজ্যের জাঁতাকলে মার খেয়েছে নাটকের এই সূতিকাগার। একের পর এক বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন গড়ে ওঠায় বেইলি রোডের শুধু জৌলুসই কমেনি, ঐতিহ্যে ও অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে দারুণভাবে। বিষয়টি নাট্যাঙ্গনের মানুষদের জন্য ভীষণ পীড়াদায়ক। মূলত ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটির মধ্য দিয়েই বেইলি রোডের মহিলা সমিতিতে দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম নাটক মঞ্চায়ন শুরু হয়। সেই থেকে দীর্ঘ চার দশক মহিলা সমিতির মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ান নাট্যকর্মীরা। বলা চলে, সমৃদ্ধ ও সফলতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ আর বেইলি রোডের নাটকপাড়া প্রায় একসঙ্গেই বেড়ে ওঠে। পাশাপাশি গাইড হাউস মিলনায়তনেও শুরু হয় নাটকের মঞ্চায়ন। নাটকের গৌরবজনক ইতিহাস বেইলি রোড ঘিরে আবর্তিত বলে নাট্যকর্মীদের দাবির মুখে বেইলি রোডের নাম পরিবর্তন করে ‘নাটক সরণি’ করা হয়। ২০০২ সালে গাইড হাউস মিলনায়তনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মহিলা সমিতির মিলনায়তনটিই নাট্যকর্মীদের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল। কিন্তু সংস্কারের জন্য ২০১১ সালে মহিলা সমিতি ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। ‘ভাঙা-গড়ার নাট্য উৎসব ২০১১’ নামে একটি উৎসবের আয়োজন করে স্মৃতিবিজড়িত মহিলা সমিতির প্রাণের মঞ্চটিকে বিদায় জানায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। ওই সময় ভাঙা-গড়ার উৎসবে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর ও অভিনেত্রী লাকী ইনাম জানান, নাটককে ঘিরে বেইলি রোডের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে এবং এই বেইলি রোডে নাটকের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে বলে এই এলাকার প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে বেইলি রোডে তারা নিজেদের বাসস্থান গড়ার জন্য ফ্ল্যাটও কিনেছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহিলা সমিতির নবনির্মিত ভবন উদ্বোধনের পরের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘ভাঙা-গড়ার নাট্য উৎসব’ নামের আরেকটি উৎসবের মধ্য দিয়ে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করে। এরই মধ্যে নাটকের মঞ্চায়নে জমে ওঠে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল। তত দিনে বেইলি রোড তথা নাটক সরণি তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে। এ নিয়ে নাট্যকর্মীদের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ।

এ বিষয়ে নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, বেইলি রোডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাটকের ইতিহাস। বেইলি রোড আর নাটক একে অন্যের পরিপূরক হলেও বাণিজ্যিকতার জাঁতাকলে আমাদের এই ইতিহাসের অংশ এখন তার ঐতিহ্য ও জৌলুস দুটিই হারিয়েছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক বেদনার। নাট্যকার ও নির্দেশক অনন্ত হিরা বলেন, বেইলি রোডের ইতিহাস নিয়ে সিনেমাও নির্মাণ হয়েছে। নাটকের এই গর্বিত ইতিহাসের অংশীদার আমাদের সব বিজ্ঞ নাট্যজন। যত দিন বাংলা নাটক থাকবে তত দিন ইতিহাসের পাতায় বেইলি রোডের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বাংলাদেশ থিয়েটারের অধিকর্তা খন্দকার শাহ আলম বলেন, বাণিজ্যিকতার জাঁতাকলে শিল্প মার খাচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই শিল্পের দৈন্য দশা। বাণিজ্যিকতার কাছে নাট্যকর্মীরাও খুবই অসহায়।

নাট্যজন কেরামত মওলা বলেন, গাইড হাউস মিলনায়তন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নাটকের অঙ্গন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে বেইলি রোড। কারণ বেইলি রোডের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সবই গড়ে উঠেছে নাটককে ঘিরে। পরবর্তীতে শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চ নির্মাণ হলেও বেইলি রোডের সেই উচ্ছ্বাস, সফলতা ও আন্তরিকতা শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে পাওয়া যায় না। মহিলা সমিতির মঞ্চ চালু হলেও সেই জৌলুস নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একবার কোনো কিছুতে গ্যাপ পড়লে তা আগের অবস্থায় নেওয়া কোনোকালেই সম্ভব নয়। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। যানজট বেড়েছে। ইচ্ছা করলেই এখন মানুষ নাটক দেখার জন্য সময় বের করতে পারে না। তাছাড়া আকাশ সংস্কৃতিও একটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, শিল্পকলা একাডেমিতে বর্তমানে নিয়মিত নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে। তার পরও শিল্পকলা একাডেমি কখনো নাটকের সমৃদ্ধ ইতিহাসের খাতায় নাম লেখাতে পারবে না। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশি নাটকের যে সম্মানজনক অবস্থান তার কৃতিত্বের পুরোটা জুড়েই বেইলি রোড। যার কারণে নাটকের ইতিহাসে বেইলি রোডের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাণিজ্যিকতার নিষ্পেষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাটকের মঞ্চায়নে বেইলি রোড ও নাটক স্বর্ণযুগে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন নাট্যকর্মীরা।

 

সর্বশেষ খবর