মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চলতি মৌসুমেও যাত্রাপালায় খরা

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলতি মৌসুমেও যাত্রাপালায় খরা

দেশে এখন ১৭৫টির মতো যাত্রাদলের নিবন্ধন রয়েছে। অথচ সংগঠিত করতে যাচ্ছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি দল। উত্তরবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা ছাড়াও আর অন্য কোথাও যাত্রা মঞ্চায়ন হবে এমন আশা করছে না যাত্রাসংশ্লিষ্টরা। এ বছর যাত্রা মঞ্চায়নের আরেকটি অনিশ্চয়তার কারণ হচ্ছে সামনে জাতীয় নির্বাচন

বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক হচ্ছে যাত্রাপালা। বিশেষ করে গ্রামীণ বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে যাত্রাপালাকেই গণ্য করা হতো। অথচ গত কয়েক দশক ধরে যাত্রাপালায় চলছে চরম আকাল। নানা কারণে হারাতে বসেছে সরল বিনোদনের এই আবশ্যক শিল্পটি। চলতি বছরও এই খরার চিত্র থেকে রেহাই পাচ্ছে না যাত্রাশিল্প। দুর্গাপূজার সপ্তমী দিন থেকে শুরু করে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত থাকে যাত্রা মৌসুম। সেই হিসেবে আগামী শনিবার থেকে এই মৌসুম শুরু হচ্ছে, কিন্তু চলতি বছরও যাত্রাপালায় খরা কাটেনি। এমনটাই ইঙ্গিত দিলেন, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সহ-সভাপতি এবং যাত্রা পালাকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ। তাঁর দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকারিভাবে বর্তমানে যাত্রাপালা মঞ্চায়নে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে আয়োজন কম। ধীরে ধীরে সৃজনশীল আয়োজকরা যাত্রাশিল্প থেকে সরে যাচ্ছেন। কারণ একসময় এই যাত্রাশিল্পে নাচের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাতে দর্শকরা যাত্রাপালার চেয়ে অশ্লীল নাচ দেখতেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। এতে করে যাত্রাশিল্পে ধস নামতে শুরু করে। স্থানীয় প্রশাসন এই অশ্লীল নাচ-গানের কারণে যাত্রাপালা মঞ্চায়নের অনুমতি দিতে অনীহা প্রকাশ করে। চলতি বছর হাতে গোনা কয়েকটি যাত্রাদল পূজা থেকে গান-বাজনা শুরু করতে যাচ্ছে। দেশে এখন ১৭৫টির মতো যাত্রাদলের নিবন্ধন রয়েছে। অথচ সংগঠিত করতে যাচ্ছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি দল। উত্তরবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা ছাড়াও আর অন্য কোথাও যাত্রা মঞ্চায়ন হবে এমন আশা করছেন না যাত্রাসংশ্লিষ্টরা। এ বছর যাত্রা মঞ্চায়নের আরেকটি অনিশ্চয়তার কারণ হচ্ছে সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের সময় কেউ যাত্রা মঞ্চায়ন করতে চায় না, প্রশাসনও অনুমতি দেয় না। এখন পর্যন্ত যে কয়েকটি দল গান-বাজনা সাজাতে যাচ্ছে তারাও অসংগঠিত বায়নায় শিল্পী সংগ্রহ করে যাত্রা মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার কিন্তু এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এবারও ১২০টি যাত্রাদলকে সংক্ষিপ্ত আকারে সমৃদ্ধি ও উন্নয়নমূলক যাত্রা মঞ্চায়নের জন্য সরকার অনুদান দিচ্ছে। তাতে আমরা যাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা সরকারকে দোষারোপ করতে পারছি না। কারণ সরকার অনুমোদন বন্ধ রাখেনি বরং সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সরকার যা দিচ্ছে সবই শিল্পকলার মাধ্যমে। ২০১২ সালে যাত্রাশিল্পের স্থায়ী নীতিমালা প্রণয়নের পর এই শিল্পকে দেখাশোনার ভার শিল্পকলা একাডেমির ওপর ন্যস্ত হয়। যার ফলে যাত্রাশিল্পসংশ্লিষ্টরা সার্বক্ষণিক শিল্পকলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। শিল্পকলা একাডেমি যাত্রার বিষয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বা এই শিল্পের গতিশীল চর্চার ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে থাকে। ফলে শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী যাত্রার মানুষদের কাছে প্রিয় মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। এদিকে কবি, গীতিকার ও যাত্রা গবেষক ড. তপন বাগচীর কথায়, ‘যাত্রাশিল্পে সংকটের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক। যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতে জেলা বা থানা প্রশাসনের অনুমতি নিলেই হয়। এখানে প্রশাসনিক কোনো বাধা নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা কমিটির কারও কারও আপত্তির কারণে যাত্রা প্রদর্শনী ব্যাহত হয়। অনুমতি দেওয়া হয় না তখন। যেখানে ওয়াজ-মাহফিল করতে অনুমতি থাকে, সেখানে যাত্রার অনুমতি মেলে না। আর আরেকটি সংকটের কারণ হচ্ছে, আগের মতো মেলায় লোক যাত্রা দেখতে আগ্রহী হয় না। মানুষের মন-মানসিকতা নেই যাত্রা দেখার। প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যাত্রা তেমন করে টানে না। যেখানে সিনেমার হল বন্ধ, সেখানে যাত্রাশিল্প কীভাবে বেঁচে থাকবে? হলে গিয়ে ছবি দেখারই তো মানসিকতা নেই, যাত্রা দেখবে কীভাবে! শিল্পকলায় নীতিমালায় একটা প্রস্তাবনা ছিল প্রত্যেক জেলায় একটি করে উন্মুক্ত মঞ্চ হবে। যেখানে যাত্রার সান্ধ্যকালীন আয়োজন হবে মৌসুমে। বিভিন্ন অবহেলা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শিল্প। বিলুপ্তির পথে এখন লোকজ সংস্কৃতির বাহক যাত্রাশিল্প। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এসব লোকজ যাত্রাপালার সোনালি যুগ ছিল। একসময় যাত্রাপালায় অভিনয় করত দেশের নামকরা সুপারস্টার, নামকরা শিল্পী, কলাকুশলী দ্বারা এই যাত্রাপালা গঠন করা হতো। যাত্রাদলে দেশজুড়ে হাজারো শিল্পী, কলাকুশলী রয়েছেন যাঁরা এ পেশা ছাড়া অন্য পেশা জানেন না। ফলে তাঁদের বড়ই দুর্দিন। ধর্মীয় গোঁড়ামি, জঙ্গিবাদের উত্থান, নাশকতা, মোড়ে মোড়ে টেলিভিশন, সিনেমা, ডিশ অ্যান্টেনার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের নগ্ন ছবির ছড়াছড়ির কাছে নুয়ে পড়েছে বাঙালি জাতির লোকজ সংস্কৃতি। সর্বোপরি মালিকদের আর্থিক দৈন্যতায়ও এ শিল্পের ভরাডুবি শুরু হয়েছে। এই লোকজ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সবাই এক হয়ে কাজ করলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। উপসংহারে বলতে হয়, বিশ্ব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে বিনোদনের অনেক মাধ্যম আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের গ্রামবাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে আজ বিলুপ্তির পথে পুঁথি পাঠের আসর, যাত্রাপালার মতো জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যমগুলো। দুর্গাপূজা এবং শীতকাল হচ্ছে যাত্রাপালার ভরা মৌসুম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই ভরা মৌসূমেও যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই বিনোদনের জনপ্রিয় এই  মাধ্যমটি আজ ঝুঁকির মধ্যে। যাত্রার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যাত্রা গবেষক ও কবি ড. তপন কুমার বাগচী লিখেছেন, ‘১৮৬০ সালে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১১-৮৮) কৃষ্ণবিষয়ক কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার যে গতি সঞ্চার করেন, চারণকবি মুকুন্দ দাসের (১৮৮৭-১৯৩৪) হাতে তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জাগরণী মন্ত্র।’ কিন্তু সেই জাগরণী মন্ত্র আজকে যাত্রা পেশাদারি শিল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে নানারকম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

সর্বশেষ খবর