রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অভিভাবকশূন্য শোবিজ অঙ্গন

অভিভাবকশূন্য শোবিজ অঙ্গন

একে একে শোবিজ জগৎ থেকে গুণী অভিনয়শিল্পীরা মহাপ্রস্থানে পাড়ি জমাচ্ছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে সৃষ্টি হচ্ছে শূন্যতা হয়ে পড়ছে অভিভাবকহীন। এ অপূরণীয় ক্ষতি ইন্ডাস্ট্রির জন্য অশনিসংকেত। সময়ের পালাবদলে হারিয়ে ফেলা সেসব গুণী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

এ দেশের টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের রয়েছে সুন্দর সোনালি অতীত। সংগীতাঙ্গনও ছিল নানারকম গানে মুখর। তখনকার নাটক মানেই তুমুল জনপ্রিয়তা। তেমনিভাবে এক একটা চলচ্চিত্র ছিল মাস্টারপিস। একই রকমভাবে গানের ইন্ডাস্ট্রিও ছিল চাঙা। সে সময় নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। কী সুন্দর সব নামের, গল্পের, সংলাপের ও অভিনয়ের নাটক-চলচ্চিত্র! সোনালি সময় থেকে নব্বই-পরবর্তী সময়ও অসংখ্য সুন্দর নামের নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দর্শক খুঁজে ফিরেছে তাদের হাসি, কান্নাভরা মুহূর্ত। কনটেন্ট ছিল মানসম্মত। একক-ধারাবাহিকের মতো প্রতিটি চলচ্চিত্রও ছিল অমর সৃষ্টি। এসবের মধ্যে তখন ছিল তারকার সমাবেশ। কে ছিলেন না! সে সময় স্ক্রিপ্ট ছিল খুবই শক্তিশালী। অভিনয় ছিল মানসম্মত। গানের জগতে একক গানের পাশাপাশি ব্যান্ড দলগুলোও তাদের জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে অ্যালবাম বের করত, কনসার্ট করত। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত প্রিয়শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারের গান। নাটক-চলচ্চিত্রে প্রিয় অভিনয়শিল্পীদের দেখতে অপেক্ষা করত। সে সময় যাঁরাই এই শোবিজ জগতে এসেছিলেন, পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ সে সময় পেয়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয়তা। অন্যদিকে আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলো নাট্যজগতে এক বিপ্লব আনে। নাটকগুলোর মধ্য দিয়ে প্রচুর দর্শক তৈরি হয়। প্যাকেজ নাটক প্রচার শুরু হওয়ার পর এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসার পরও কিছু কিছু ধারাবাহিক নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একটি নাটকের চরিত্র দর্শকদের কাছে কতটা আপন হতে পারে তা ‘আজ রবিবার’ নাটকে আবুল খায়ের অথবা আলী যাকেরের অভিনয় প্রমাণ করে। এ দুই নাট্যজন আজ নেই। চলে গেছেন সব মায়া সাঙ্গ করে। আজ হুমায়ুন ফরীদিও নেই এ শোবিজ জগতে। ২০১৯ সালের মে মাসে হারালাম প্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দীকে। অন্যদিকে আশি-নব্বই দশকে বিটিভির কালজয়ী ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’-এ বড় মালু চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন ধ্রুপদী যোদ্ধা মুজিবুর রহমান দিলু। তিনিও ২০২০ সালে মহাপ্রস্থানে পাড়ি জমিয়েছেন। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ১১ তারিখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা-নাট্যকার নাট্যজন ড. ইনামুল হক। একই বছর চলে যান চিত্রনায়িকা কবরী। ‘কোথাও কেউ নেই’-এর বাকের ভাইয়ের সঙ্গী বদি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করা আবদুল কাদের-শূন্য এই নাটক ইন্ডাস্ট্রি। আজ নাট্যাঙ্গনে সেই দীপ্ত পদচারণা নেই গোলাম মুস্তাফা, আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আলী আহসান সিডনী, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, এস এম মহসীন, কে এস ফিরোজ, চ্যালেঞ্জার, সালেহ আহমেদ, মাহমুদা খাতুন, খালেদ খান, মোজাম্মেল হক, রওশন জামিল, নাজমা আনোয়ার, হুমায়ুন ফরীদি, মিনু মমতাজ, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো সব্যসাচী গুণী অভিনেতাদের। তাঁরা অভিনয়ে মুগ্ধতা ছড়াতেন। শোবিজে তাঁদের ক্রেজ ছিল সর্বদা তুঙ্গে। আবার এই সময়ের অনেক অভিনেতা যেমন- সেলিম আহমেদ, হুমায়ুন সাধুরাও নেই। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার মাসুম আজিজ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান পরপারে। কিংবদন্তি গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ারও একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চলে যান না ফেরার দেশে। ভবের মায়া ত্যাগ করে এ বছর আরও পৃথিবীর ছেড়ে চলে যান সুরকার আলম খান, অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ, আকবর, প্রযোজক-নির্মাতা আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান বুলি, গীতিকার কে জি মোস্তফাসহ অনেক গুণী মানুষ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান ঘুড্ডিখ্যাত নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। এই তো ১৮ অক্টোবর চলে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা শফি বিক্রমপুরী। অন্যদিকে গুণী নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতুল্লাহ মারা যান এ বছরের ২০ সেপ্টেম্বর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও ফুসফুস সংক্রমণে আক্রান্ত ছিলেন।

একটা সময় চলচ্চিত্র-নাটকে সদর্পে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আমিরুল হক চৌধুরী, দিলারা জামান, নিমা রহমান, আবুল হায়াত, সারা যাকের, মামুনুর রশীদ, লাকী ইনাম, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডলি জহুর, তারিক আনাম খান, আফরোজা বানু, লুৎফুর রহমান লতা, নায়লা আজাদ নূপুর, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, মাসুম বাশার, হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, গাজী রাকায়েত, চিত্রলেখা গুহ, নরেশ ভূঁইয়া প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন। সুভাষ দত্ত, সত্য সাহা, নায়করাজ রাজ্জাক, নায়ক ফারুকের মতো গুণীজনশূন্য এখন এই মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি। একইভাবে প্লেব্যাক সিঙ্গার বা নিয়মিত গানে দেখা যেত এন্ড্রু কিশোর, সৈয়দ আবদুল হাদী, আবদুল জব্বার, লাকী আখন্দ, বশীর আহমেদ, রফিকুল আলম, মাহমুদুন নবী, খুরশীদ আলম, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, ফেরদৌসী রহমান, নীলুফার ইয়াসমিন, আইয়ুব বাচ্চুসহ অনেক গুণী শিল্পীকে। যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখন প্রয়াত। সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রবীন ঘোষসহ অনেকেই পৃথিবীতে নেই এখন। আর যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মূল্যায়নও খুবই কম এই ইন্ডাস্ট্রিতে। এদিকে উত্তরসূরিদের পথ ধরে যাঁরা মিডিয়ায় এসেছেন, এখনো তাঁদের নিয়ে দর্শকের মাঝে অন্যরকম আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাঁদের পরবর্তীতে কালে কালে অনেক অভিনয় ও সংগীতশিল্পী মিডিয়ায় এসেছেন। কাজ করেছেন বা করছেন। কিন্তু এসব প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে আগ্রহ বা তাঁদের পরিচিতি নিয়ে দর্শকদের মাঝে আগ্রহ খুবই কম। এখন তো নাটকের ভিউ বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য নাটকের যাচ্ছেতাই নাম রাখা হচ্ছে। দর্শক দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে নিম্নমানের গল্প, উদ্ভট ও অশ্লীল সংলাপ, নতুনদের বিরক্তিকর অপেশাদারি অভিনয়, নির্মাতাদের আনাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি ইদানীং যোগ হয়েছে নাটকের উদ্ভট সব নাম! আবার ভিউ ধরতে ব্যবহৃত হচ্ছে অসামঞ্জস্য ইংরেজি নাম, উদ্ভট পোস্টার। সেই অর্থে নাটকের মানের দিকে কোনো খেয়াল নেই কারও। একই দশা দেশের চলচ্চিত্র ও ওটিটি ইন্ডাস্ট্রিতে। সবমিলিয়ে অভিভাবকশূন্যতার দরুণ দুর্দশায় শোবিজ ইন্ডাস্ট্রি, যা সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি। এভাবে চললে শোবিজ জগৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এ নিয়ে কে ভাববে!

সর্বশেষ খবর