বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঢাকাই ছবিতে বিদেশি নায়িকার হিড়িক

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঢাকাই ছবিতে বিদেশি নায়িকার হিড়িক

গত মঙ্গলবার ঢাকাই ছবির নায়ক শাকিব খান উড়ে গেলেন ভারতের মুম্বাইয়ে। সেখানে তিনি শুটিংয়ে অংশ নেবেন বাংলাদেশের ছবি ‘দরদ’-এর শুটিংয়ে। ছবিটি নির্মাণ করছেন এ দেশেরই চিত্রনির্মাতা অনন্য মামুন। আর এই ছবির নায়িকা হলেন বলিউড অভিনেত্রী সোনাল চৌহান।

অন্যদিকে ঢাকার নির্মাতা হাসিবুর রেজা কল্লোল নির্মাণ করতে যাচ্ছেন ‘কবি’ শিরোনামের একটি ছবি। এর নায়িকা হলেন কলকাতার চিত্রনায়িকা ইর্র্ধিকা পাল। এই ইধিকা পাল অবশ্য কলকাতর ছবির নায়িকা ছিলেন না। তিনি ছিলেন কলকাতার ছোট পর্দার সিরিজ নাটকের শিল্পী। বাংলাদেশের নির্মাতা হিমেল আশরাফ তাঁকে ছবির নায়িকা করে আনেন তাঁর ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে। অথচ এই ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল বুবলীর। এদিকে কামরুজ্জামান রোমান তাঁর নির্মাণাধীন ‘লিপস্টিক’ ছবির নায়িকা করে আনতে চেয়েছিলেন কলকাতার দর্শনা বণিককে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিসা জটিলতায় দর্শনা আসতে না পারায় দেশি নায়িকা পূজা চেরিকে নিয়ে ছবিটির কাজ শুরু করেন তিনি। এই দর্শনা বণিক বছরকয়েক আগে বাংলাদেশের ছবি ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘অন্তরাত্মা’য় অভিনয় করেছিলেন। সম্প্রতি কামরুল ইসলাম রিফাতের ‘ওয়ান ইলেভেন’ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন কলকাতার অভিনেত্রী স্বস্তিকা। আরও জানা গেছে, নির্মাতা হিমেল আশরাফ ‘রাজকুমার’ নামে আরেকটি ছবি নির্মাণ করবেন যার নায়িকা হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক শিল্পী কোর্টনি কফি। এছাড়া কিছুদিন আগে তাজু কামরুলের ‘ছায়াবাজ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছিল কলকাতার নায়িকা সায়ন্তিকাকে।

বাংলাদেশের ছবিতে বিদেশি নায়িকার অভিনয় করাটা নতুন কোনো বিষয় নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ দেশের ছবিতে বিশেষ করে কলকাতার নায়িকাদের অভিনয় করা শুরু হয়। এ দেশে প্রথম কলকাতার নায়িকাকে নিয়ে কাজ করেন মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। ১৯৭৫ সালে তিনি কলকাতার ছবির নায়িকা সোমা মুখার্জিকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘এপার ওপার’ ছবিটি। বিদেশি নায়িকা নিয়ে কাজের সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। তবে এ বিষয়টি দেশীয় অনেক নির্মাতার কাছে এখন আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ হিসেবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সিনিয়র নির্মাতা বলছেন, দেশীয় চলচ্চিত্রের বাজার বিদেশে সম্প্রসারণের নামে যৌথ ছবি বা স্থানীয় ছবিতে ভারতীয় শিল্পী এনে ফায়দা লুটছে একশ্রেণির অসাধু নির্মাতা-প্রযোজক। বিনোদনের আড়ালে সাদা হচ্ছে কালো টাকা। ভিনদেশি শিল্পীরা দেশের টাকা নিয়ে যাচ্ছেন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে। এসব অসাধু কর্মকাণ্ডের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দেশীয় শিল্পীদের ক্যারিয়ার অনেক আগেই হুমকির মুখে পড়েছে। বেকারত্বের কবলে পড়েছেন তাঁরা। সিনিয়র নির্মাতারা বলছেন, দেশীয় চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকটের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে অনেকে বিদেশি শিল্পী এনে এখানে কাজ করাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে বেশির ভাগ বিদেশি শিল্পী ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই এখানে কাজ করছেন। অনেকের কথায় শুধু অভিনয়শিল্পী নয়, বিদেশি নির্মাতা, কণ্ঠশিল্পী, ফাইট ও মিউজিক ডিরেক্টরসহ নানা কলাকুশলী কাজ করছেন ঢাকার ছবিতে। এতে বেকার হয়ে পড়ছেন স্থানীয় সংশ্লিষ্টরা। হুমকির মুখে পড়েছেন দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প ও শিল্পী-কলাকুশলীরা। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ছটকু আহমেদ উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিলেন, দেশীয় অনেক শিল্পী-কলাকুশলী বেকার রয়েছেন ছবির অভাবে। কিছু নির্মাতা বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সেদিকে দৃষ্টি নেই। তাঁরা বিদেশি শিল্পী-কলাকুশলী নিয়েই কাজ করতে বেশি আগ্রহ দেখান। অবস্থাটা এমন- ‘বিদেশি শিল্পী নিলেই তাঁর ছবি হয়ে যাবে আন্তর্জাতিক মানের এবং সেই নির্মাতাও হয়ে যাবেন হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা স্পিলবার্গ বা জন ক্যামেরুন। দুঃখ একটাই, অনেকে কেন বুঝতে চান না, ছবি চলে গল্প আর নির্মাণের জোরে। এরপর আসে শিল্পীর বিষয়টি। আমাদের দেশে শক্তিমান অভিনয়শিল্পীর কোনো অভাব নেই। তারপরও তাঁদের অবজ্ঞা করে অনেকে ছুটছেন বিদেশি শিল্পীদের পেছনে। এটি একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিবিরুদ্ধ কাজ। যৌথ প্রযোজনার বিষয়টি ভিন্ন। ‘নির্মাতাদেরও দেশীয় শিল্পী-কলাকুশলীদের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছবির নায়ক-নায়িকা হিসেবে বিদেশি তারকাদের দিকে ঝুঁকছে, চমক রাখার প্রত্যাশায়। এটি আসলে চমক নয়, স্ববিরোধিতার নামান্তর মাত্র।’ বলছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক-গবেষক অনুপম হায়াৎ। প্রায়ই অনেক নির্মাতা ঘটা করে ঘোষণা দেন, ‘আমার ছবির নায়ক, নায়িকা বা খলনায়ক হবেন বিদেশের অমুক শিল্পী। এ কথা শোনার পর এ দেশের শিল্পী-কলাকুশলীরা চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েন। তাঁদের কথায় ছবির অভাবে দেশীয় শিল্পীরা যখন বেকার তখন বিদেশি শিল্পীদের এনে কাজ করানো মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।’ ‘একসময় প্রচুর ছবি নির্মাণ হতো ঢালিউডে। শিডিউল পাওয়া যেত না শিল্পীদের। তাই অনেকে বিদেশি শিল্পী নিয়ে কাজ করতেন কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। এখন এ দেশের শিল্পীদের আগে কাজ দিয়ে বাঁচাতে হবে।’ বলেছেন চলচ্চিত্রকার সুচন্দাসহ অনেকে। ২০১২ সালে নির্মাতা অনন্য মামুন যৌথ প্রযোজনায় কলকাতার সঙ্গে নির্মাণ করেন ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবিটি। ওই সময় যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় শিল্পী-কলাকুশলীর বিষয়ে সমানুপাতিক হারের শর্ত ছিল না। এই সুযোগের অপব্যবহার করে তখন ওই নির্মাতা বাংলাদেশ থেকে নামেমাত্র একজন শিল্পী মিশা সওদাগরকে নেন ছবিটিতে। বাকি সবাই ছিলেন কলকাতার। ছবিটির প্রধান দুই অভিনয়শিল্পীই ছিলেন কলকাতার। শুভশ্রী ও অংকুশ। এ নিয়ে তখন দেশীয় চলচ্চিত্রকাররা নির্মাতা অনন্য মামুনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। গত কয়েক বছরে ঢাকায় যৌথ বা একক প্রযোজনার হাত ধরে ঋতুপর্ণা ছাড়াও কলকাতার যে সব নায়িকা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- শুভশ্রী [আমি শুধু চেয়েছি তোমায়, প্রেম কী বুঝিনি, নবাব], পাওলি দাম [সত্তা], শ্রাবন্তী [শিকারি, নবাব, চালবাজ, যদি একদিন], প্রিয়াঙ্কা সরকার [হৃদয়জুড়ে]। এখন পর্যন্ত বিদেশি শিল্পী যাঁরা ঢাকার ছবিতে কাজ করেছেন তাঁদের তালিকা খুব একটা সংক্ষিপ্ত নয়। এসব শিল্পীর মধ্যে রয়েছেন- সোমা মুখার্জি, শতাব্দী রায়, বনশ্রী, ঝুমুর গাঙ্গুলী, জয়শ্রী কবির, সুনেত্রা, দেবশ্রী, মুনমুন, সন্ধ্যা রায়, আলপনা গোস্বামী, ইন্দ্রানী হালদার, শাবানা আজমী, জয়া প্রদা, মমতা কুলকার্নি, ভাগ্যশ্রী, নীলম, আয়শা জুলেখা, মনিকা দেবী, প্রিয়াংকা ত্রিবেদী, রাবিনা, মিনা, শিবানী, ঋতুপর্ণা, রচনা ব্যানার্জি, শ্রীলেখা মিত্র, মাহিমা, রিংকু ঘোষ, মিত্র যোশী, মধুমিতা, প্রিয়া, রিয়া সেন, রাইমা সেন, রাভিনা, ভিক্টর ব্যানার্জি, আইয়ুব খান, চাংকি পান্ডে, মিঠুন চক্রবর্তী, রঞ্জিত মল্লিক, আশীষ বিদ্যার্থী, রজতাভ দত্ত, প্রসেনজিৎ, জিৎ, অংকুশ, সোহম, ওম, হিরণ, পরমব্রত, ইন্দ্রনীল, স্বস্তিকা, স্নেহা উল্লালসহ আরও অনেকে।

সর্বশেষ খবর