মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেমন চলছে সিনেমা ও সিনেমা হল

যেমন চলছে সিনেমা ও সিনেমা হল

দীর্ঘদিন পর সিনেমা ও সিনেমা হলের পালে সুবাতাস বইছে বলে দাবি করছেন সিনেমা নির্মাতা ও সিনেমা হল মালিকরা। তাঁদের ইতিবাচক দাবির বিপরীতে আবার নেতিবাচক কথাও রয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণ ধরে রাখায় ব্যর্থতার জন্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে দুষছেন। কি বলছে তাঁরা সেই কথাই তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

ভালো ছবি পেলে সিনেমা হল উন্নয়ন কোনো ব্যাপার নয় : মিয়া আলাউদ্দিন

(সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রদর্শক সমিতি)

‘এই দেখি সোনার ছবি এই দেখি নাই...’ আমাদের সিনেমা হল ও সিনেমার অবস্থা বর্তমানে প্রখ্যাত পল্লী গানের সম্রাট প্রয়াত আবদুল আলীমের এই গানের মতোই হয়ে গেছে। দেখা যায় কালেভদ্রে ভালো ছবি পেলে কিছু বন্ধ সিনেমা হল খুলছে আবার ভালো সিনেমার অভাবে সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে। মানে মানসম্মত পর্যাপ্ত পরিমাণে সিনেমা পাওয়াটাই হচ্ছে সিনেমা হল চালু রাখার মূল নিয়ামক। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘প্রিয়তমা’ ছবিটি যে পরিমাণ ব্যবসা করেছে গত ১০ বছরে এর ধারেকাছে এমন ব্যবসাসফল ছবি আর মুক্তি পায়নি। এই ছবিটির দুর্দান্ত ব্যবসায়িক সফলতার কারণে অনেক বন্ধ সিনেমা হলের মালিক উৎসাহিত হয়ে তাঁদের বন্ধ সিনেমা হল পুনরায় খুলেছেন এবং মুনাফা পেয়ে তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছে। কিন্তু সেই হাসি চিরস্থায়ী হয়নি। কারণ এরপর আর কোনো দর্শকগ্রহণযোগ্য ছবি তেমন পাওয়া যায়নি। ফলে আবার তাঁরা তাঁদের সিনেমা হল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমার কথা হলো সিনেমা হিট হলে টাকা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা আসবে, দর্শক আসবে, সিনেমা হল মালিক ও সিনেমা নির্মাতা প্রাণ খুলে হাসবে। দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা না চলার আরেকটি কারণ হলো প্রচার-প্রচারণা না থাকা। একসময় সিনেমা মুক্তির অনেক আগে থেকেই পত্র-পত্রিকা, লিফলেট, ব্যান্ডপার্টি, ট্রাকে এবং সিনেমা হলে আলোকসজ্জা, রেডিও-টিভিতে প্রচারণা চালিয়ে ছবিটির ব্যাপক পাবলিসিটি করা হতো। পোস্টারে পোস্টারে ভরে যেত রাস্তার দুই পাশের দেয়াল। সেই প্রচার-প্রচারণার দৃশ্য এখন একেবারেই অদৃশ্য। ফলে একটি ছবি মুক্তির ব্যাপারে সেই সিনেমাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানছে না। এতে করে একটি সিনেমা কখন মুক্তি পাচ্ছে আবার কখন সিনেমা হল থেকে নেমে যাচ্ছে তা মানুষের অগচোরেই রয়ে যাচ্ছে। ফলাফল দর্শকশূন্য সিনেমা হল। আসলে চলচ্চিত্র যে একটি শিল্প তা চলচ্চিত্রের মানুষের অব্যবস্থাপনা ও অজ্ঞতার কারণে সাধারণ মানুষও ভুলে যাচ্ছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে এখন অন্যসব ব্যবস্থার সঙ্গে বিদেশি ছবি আমদানির কোটা ফ্রি করে দিতে হবে। না হলে নানা প্রক্রিয়া পালন করতে গিয়ে আমদানি ও আমদানিকৃত ছবিটি এখানে মুক্তি বিলম্বিত হয়। ফলে এখানে মুক্তির আগেই ছবিটি দর্শক বিভিন্ন মাধ্যমে দেখে ফেলে বলে সেটি আর দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে দেখে না। অন্যদিকে সিনেমা হল নির্মাণ, আধুনিকায়ন ও সংস্কারে ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার যে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে সেখানে ব্যাংক সিনেমা হল মালিকদের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিচ্ছে না। ঋণ পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো জমির মালিকানা ঠিক আছে কি না এবং ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে কি না। কিন্তু এর বাইরেও ব্যাংক নানা অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করছে বলে সিনেমা হল মালিকরা এই ঋণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এই ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আরেকটি ভীতি হলো উচ্চ সুদের হার বেঁধে দেওয়া। সরকার যেভাবে সাড়ে ৪ পার্সেন্ট সুদের হার বেঁধে দিয়েছে তাতে করে মাসে ৩০ লাখ টাকা করে ব্যাংককে পরিশোধ করতে হবে। যেহেতু নিয়মিতভাবে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছবি পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে একজন সিনেমা হল মালিক এই ঋণ নিয়ে তা কীভাবে পরিশোধ করবেন। ৩৪টি সিনেমা হল মালিক অগ্রণী ব্যাংককে এবং ১০টি সিনেমা হল মালিক সোনালী ব্যাংকে দীর্ঘদিন আগেই ঋণের জন্য আবেদন করলে তা ব্যাংকের অযৌক্তিক শর্ত ও তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই আটকে আছে। সিনেমা হল মালিকরা ঋণের মুখ আর দেখছেন না। প্রিয়তমা ও মুজিব : একটি জাতির রূপকার সিনেমা মুক্তির সময় শতাধিক সিনেমা হল খুললেও বাস্তবে সারা দেশে চালু রয়েছে মাত্র ৬০টির মতো। মফস্বলের সিনেমা হলগুলোর অবস্থা এখনো করুণ। সেখানে দেশি ভালো ছবি না হলে দর্শক ছবি দেখতে যায় না। সবমিলিয়ে দেশি সিনেমার সুদিন ফেরা এখন সুদূরপরাহত।

সিনেমা হল মালিকরা বেনিয়াই রয়ে গেছেন : কাজী হায়াৎ

(সভাপতি পরিচালক সমিতি)

চলচ্চিত্রের গতি ও ধারা পরিবর্তিত হয়েছে। সেই ধারায় প্রচুর ছবি নির্মিত হচ্ছে। আগের বাণিজ্যিক ধারা পাল্টে গেছে। নতুন ধারার সব ছবি দর্শক সিনেমা হলে টানতে পারছে না। মাঝে মধ্যে দুই-একটি ছবি সিনেমা হলে দর্শক আনছে। আসলে এসব নতুন ধারার ছবির টার্গেট হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফরম। এই ধারার ছবির দর্শক সাধারণ মানুষ নয়। এরা একেবারে প্রান্তিক মানুষ। অবিলম্বে এই ধারার পরিবর্তন হবে। এদিকে সিনেমা হল মালিকদের সঙ্গে কথা ছিল ছবি ভালো ব্যবসা করলে তাঁরা সিনেমা হলের আধুনিকায়ন করবে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। সিনেমা হল মালিকরা বেনিয়াই রয়ে গেছেন। তাঁরা ছবি থেকে যে লাভ পাচ্ছেন তা দিয়ে সিনেমা হলের উন্নয়নের পরিবর্তে অন্য খাতে ব্যয় করছেন। আমার প্রত্যাশা, সিনেমা হল মালিকদের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে বোধোদয় হবে সিনেপ্লেক্সের দর্শক দেখে। এসব দর্শক তো আকাশ, চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেনি। এরা সিনেপ্লেক্সে যায় কিন্তু সিনেমা হলে যায় না কেন? এই সিনেপ্লেক্সের দর্শকদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সিনেমা হল মালিকদের। তাহলেই সামগ্রিক সিনেমার উন্নতি হবে এবং যে মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে সেখানেও লগ্নি হবে। অনেক লগ্নিকারক বসে আছেন সিনেমা নির্মাণের জন্য। কিন্তু সিঙ্গেল স্ক্রিনের দুরবস্থা দেখে তাঁরা এগোচ্ছেন না। আমি আশা করি এই কালো মেঘ সবদিক থেকেই কেটে যাবে এবং সিনেমা ও সিনেমা হলের ব্যবসা উন্নত হবে।

সর্বশেষ খবর