সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিনেমা হল উন্নয়ন থেমে আছে যে কারণে

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা হল উন্নয়ন থেমে আছে যে কারণে

দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের সদিচ্ছার সীমা নেই। এ লক্ষ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণে দফায় দফায় সরকার সরকারি অনুদানের অর্থ বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। শুধু ভালো ছবি নির্মাণ করলে চলবে না। ছবি প্রদর্শনের জন্য চাই দর্শক উপযুক্ত সিনেমা হল। আর তাই সরকার এই দিকটায়ও নজর দিয়েছেন। ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনেমা হল নির্মাণে ঋণ তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। এর দুই দিন পর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সমিতির নেতারা। তখন বন্ধ হয়ে যাওয়া হলের সংস্কার ও নতুন সিনেমা হল তৈরিতে স্বল্প সুদে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার উদ্যোগের কথা জানায় সরকার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঋণ তহবিলের পরিমাণ বাড়িয়ে ১ হাজার কোটি টাকা করা হয়। পরবর্তীতে ৫০০ কোটি টাকা প্রথম পর্যায়ে ছাড় করানো হয়। এই ঋণ বিতরণে সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের দায়িত্ব দেয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির অভিযোগ বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও শুধু ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে ঋণ পাচ্ছে না সিনেমা হল মালিকরা। প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস জানান, এখন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে ৩৫টি, সোনালী ব্যাংকে পাঁচটি ও রূপালী ব্যাংকে চারটি আবেদন ও প্রজেক্ট প্রোফাইল জমা পড়ে আছে। কিন্তু ব্যাংকের নানা তালবাহানার কারণে ঋণের দেখা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর উদাহরণ টানতে গিয়ে সুদীপ্ত দাস বলেন, অভিনেতা ডি এ তায়েব অগ্রণী ব্যাংকের হেড অফিস ও মির্জাপুর ব্রাঞ্চ অফিসে প্রোজেক্ট প্রোফাইল জমা দিয়েছেন প্রায় দেড় বছর আগে। কিন্তু ব্যাংক ঋণ প্রদানে যে ৩৭টি অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করেছে তা কারও পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয় বিধায় এই আবেদনটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অভিনেত্রী অঞ্জনা প্রজেক্ট প্রোফাইল জমা দিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকের মাধবদী শাখায়। কিন্তু চার মাস তাঁকে ঘোরানোর পর ব্যাংক কঠিন শর্ত দিয়ে তাঁকে জানায় এসব শর্ত পূরণ না করলে ঋণ দেওয়া যাবে না। এরপর অঞ্জনা সোনালী ব্যাংকের নরসিংদী শাখায় আবেদন জমা দিলেও এখন পর্যন্ত তা ব্যাংকের নানা শর্তের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে। চিটাগাং রোডে মুন সিনেপ্লেক্সের মালিক চান মিয়া পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করে সেখানে ডায়াগনস্টিক ও কনভেনশন সেন্টার চালু করলেও তাঁর প্রজেক্ট প্রোফাইল নিয়ে ব্যাংক তালবাহানা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংকের হেড অফিস ঋণ প্রদানের জন্য নারায়ণগঞ্জের করপোরেট অফিসকে নির্দেশ দিলেও সেই নির্দেশ করপোরেট অফিস গায়ে মাখছে না। রংপুরের গোবিন্দগঞ্জের প্রবীণ ব্যবসায়ী ইদ্রিস মিয়া তাঁর প্রস্তাবিত হীরক সিনেমা হলের জন্য পাঁচতলা ভবন তৈরি করে সেখানে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালু করা সত্ত্বেও অগ্রণী ব্যাংকের গোবিন্দগঞ্জ ব্রাঞ্চ অফিস ও গাইবান্ধার জোনাল অফিস গত দেড় বছর ধরে নানা তালবাহানায় তাঁর প্রার্থিত ঋণ প্রদান বন্ধ করে রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর উর্বশী সিনেমা, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের মনিকা সিনেমাসহ প্রায় অর্ধশত সিনেমা হল মালিকের প্রোজেক্ট প্রোফাইল বছরের পর বছর আটকে রেখে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে সরকারের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করছে।

প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জল বলছেন, ব্যাংকের নানা শর্তের মধ্যে রয়েছে, জমি বন্ধক দিয়ে যে ঋণ চাওয়া হবে তার ৫ পার্সেন্ট অর্থ আগে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এছাড়া যারা নতুন সিনেমা হল করার জন্য ঋণ চাইবে তাদের আগে ভবন নির্মাণসহ ৪০ ভাগ কাজ ঋণ পাওয়ার আবেদন করার আগে সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু এসব সহ আরও অনেক কঠিন শর্ত আবেদনকারীদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ঋণ পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো জমির মালিকানা ঠিক আছে কি না এবং ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে কি না। কিন্তু এর বাইরেও ব্যাংক নানা অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করছে বলে সিনেমা হল মালিকরা এই ঋণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে  ফেলেছে। এই ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আরেকটি ভীতি হলো উচ্চ সুদের হার বেঁধে দেওয়া। সরকার যেভাবে সাড়ে ৪ পার্সেন্ট সুদের হার বেঁধে দিয়েছে তাতে একজন সিনেমা হল মালিক এই ঋণ নিয়ে তা কীভাবে পরিশোধ করবে? এদিকে কয়েকটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ম্যানেজাররা জানাচ্ছেন, এখন যে সব ছবি নির্মাণ হয় সেগুলো দর্শক দেখে না। ছবি যদি সিনেমা হলে না চলে তাহলে সিনেমা হল মালিকরা এই ঋণের টাকা ফেরত কীভাবে দেবেন। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা বেঁধে দিয়েছে যে, বিতরণকৃত ঋণের টাকা যদি সংশ্লিষ্ট সিনেমা হল মালিকরা পরিশোধ করতে না পারেন তাহলে সেই টাকা প্রদানকৃত তফসিলি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কেটে নেবে। ফলে ঋণ বিতরণে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই আগে আমাদেরই দেখতে হবে।

এদিকে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান  উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, ব্যাংকের এই অসহযোগিতার কারণে আমি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদনপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সালাউদ্দীনের কাছে জমা দিয়েছি। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী এর একটি সুন্দর উপায় বের করে দেবেন।

সর্বশেষ খবর