রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

তিরিশের জয়রথে আগুনপাখি

তিরিশের জয়রথে আগুনপাখি

ছক ভাঙা এক মিউজিক্যাল জার্নির নাম নচিকেতা চক্রবর্তী। তিনি অপ্রতিরোধ্য। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে হাঁটাটা যেন তাঁর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। এই নগরবাউল দুই বাংলার  মানুষকে গানে গানে ৩০ বছর মাতিয়ে রেখেছেন। তাই কলকাতার পর এবার ঢাকার মঞ্চে উদযাপিত হলো নচিকেতার সংগীতের ৩০ বছর। ‘তিন দশকে নচিকেতা’র ঢাকায় উদযাপন নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

ক্যাসেট ফিতা আর সিডির যুগ ভুলতে বসা বাঙালিরা ব্যস্ত এ সময় মুঠোফোন,  হোম থিয়েটার আর কনসার্ট নিয়ে। কিন্তু আধুনিক বাংলা পপগানের প্রতি এতটুকুও আবেগ বদলায়নি খাঁটি সংগীতপ্রেমীদের। তা দেখা গেল শুক্রবার সন্ধ্যায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে। দীর্ঘদিন পর বাংলা আধুনিক গানের মহাতারকা নচিকেতা চক্রবর্তী একটা সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দিলেন ঢাকার ভক্তদের। ৩০ বছর পেরিয়েও একই রকম তারুণ্যে মঞ্চে জ্বলে উঠলেন তিনি। কখনো হাসলেন, কখনো দৃপ্ত ভাষায় বলে গেলেন নিজের ভাবনাগুলো। প্রতিবাদের কথা শোনালেন আবার গানের সুরে ভেজালেন। হলভর্তি ভক্ত তাঁর একটার পর একটা গানে মেতে থাকেন প্রায় দুই ঘণ্টা। নচিকেতাও মন উজাড় করে গাইলেন তাঁর প্রিয় সব গান। ছিল কথার জাদুও। গান শেষ হলেই দর্শক সারি থেকে আসছিল মুহুর্মুহু করতালি। এমন দৃশ্যই ফুটে উঠল নচিকেতা চক্রবর্তীর গানের সন্ধ্যায়। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দড়ি আর সেই একই চিরচেনা পোশাক। পায়ে সাদা ক্যাডস, কালো জিন্সের সঙ্গে আস্তিন গুটানো সাদা শার্টের ওপর ধূসর রঙের কটি। গলায় প্যাঁচ দিয়ে জড়ানো সাদা-কালো ডোরাকাটা মাফলার। নচিকেতা গেয়ে শোনালেন অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন, তুমি আসবে বলেই, অ্যাম্বিশন, অনির্বাণ, ইচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রম, তারায় আগুন, যখন সময় থমকে দাঁড়ায়, রাজশ্রী, মন্ত্রী বানাব, এই সময়ের নীলাঞ্জনাসহ লাল ফিতে সাদা মোজার সেই নীলাঞ্জনাদের জন্য প্রথম ভালো লাগার অনুভূতি। তবে গ্যাজেটবিমুখ নচিকেতা সেদিন মোবাইলের ভিডিও করতে থাকা দর্শকদের গানের কথায় মনোযোগ দিতে অনুরোধ করে বললেন, ‘এই যন্ত্রটা খুবই বিরক্তিকর। একটা লোক গান গাইছে, তা না শুনে ভিডিও করে যাচ্ছে। এখন যা বলছি, সেটাও ভিডিও করছে। আসলে বুঝতেই পারছে না, কী বলছি। আর একটা কথা সবাইকে বলতে চাই, আমার কোনো ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল নেই। আমি টেপাওয়ালা মোবাইল এখনো ব্যবহার করি।

তিনি গানের সুতা টেনে মাঝে আরও বলেন, ‘শুয়ে শুয়ে এখনো মাঝে মধ্যে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি... আগামীকাল কী খাব? ঠিক যে টেনশন করতাম ৩০ বছর আগে, সেই দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠি।’ কোনো এক মুহূর্তে বলে উঠছিলেন, ‘দর্শকের দিকে লাইট দাও। দর্শকদের না দেখে গান করা যায় নাকি? মনে হচ্ছে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গান করছি।’ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিরক্তির কথা জানিয়ে নচিকেতা জানান, ‘মায়েরা সন্তানদের স্কুলের টিফিন দিয়ে বলে দেন, ‘একা একা খাবি, কাউকে দিবি না; ‘এটা করবি না, ওটা করবি না’। বাচ্চার পেছনে মায়েরা যেভাবে লেগে থাকেন, সেভাবে যদি দেশটা নিয়ে লাগত- তখন দেশটাই পাল্টে যেত। এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমার অনেক রাগ।’ শাসকদলের সঙ্গে নচিকেতার সখ্য সবারই জানা। আজও কি অন্যায় দেখলে সেই গান তিনি গেয়ে উঠবেন? তাঁর প্রতিউত্তর, ‘আমি তো গাইছি। আমি আজও বলতে পারি, ‘মন্ত্রীরা সব হারামজাদা, আস্ত বদের ধাড়ি, তুড়ুক নাচে, মন্ত্রিসভা এখন বাইজি বাড়ি।’ নচিকেতাময় সন্ধ্যাটি শুরু হয় কনসার্টের আয়োজক ও সংগীতশিল্পী জয়শাহরিয়ারের গানের মধ্য দিয়ে। তিনি একে একে পরিবেশন করেন ‘তোমাকে আসতেই হবে’, ‘আমি তো এমনই’, ‘আমি নেই’, ‘ঠিক এভাবেই’ ও ‘সত্যি বলছি’- গান গাওয়ার মাঝেই জয় শাহরিয়ারকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে নচিকেতা বলেন, ‘আমি এই ছেলেটাকে ভীষণ পছন্দ করি।’ এরপর দুজনে গেয়ে শোনান জয়ের লেখা ও সুরে নচিকেতার গাওয়া ‘শেষ সময়’। গানের ফাঁকে নিজের ৩০ বছরের সংগীত ক্যারিয়ার বিষয়ও তুলে ধরেন এই কিংবদন্তি। তিনি সংগীত ক্যারিয়ার শুরুর স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘১৯৯৩ সালে শুরু করেছিলাম, ৩০ বছর তো হয়ে গেল। একটু আগেই একজন জিজ্ঞাসা করছিল, আমার চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হয়েছে কি না? আমার মনে হয়, আমার সব পাওয়া হয়ে গেছে।’ এ বছর ৫৯ বছর পূর্ণ হলো এই নগরবাউলের। মাঝে বহুদিন গান গাওয়া থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। এরপর তো ‘আগুনপাখি’ ব্যাক অন অ্যাকশন। সেদিন ঢাকা দেখল অন্য এক নচিকেতাকে, যাঁর গান শুনে লাল ফিতে সাদা মোজার নীলাঞ্জনারা অনুভব করেছে প্রথম ভালো লাগার অনুভূতি। যাঁর গান শুনে নয়ের দশক থেকে এখনো চায়ের কাপ হাতে রকের আড্ডা জমে গানের ঝংকারে। অন্যদিকে তাঁর ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শুনে চোখ ভিজেছে বৃদ্ধের। ‘নচিকেতা লাইভ ইন ঢাকা উইথ জয় শাহরিয়ার’ শীর্ষক এ আয়োজনের উদ্যোক্তা ‘আজব কারখানা’ ও ‘আজব রেকর্ড’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল হাসান বাবু ও কাজী বুশরা আহমেদ তিথি। নচিকেতার সঙ্গে তবলায় ছিলেন প্রজেনজিৎ, গিটারে রুপক এবং কি-বোর্ডে অর্ঘ্য কমল। রুপক এবং অর্ঘ্যও একটি করে দুটি গান গেয়ে শোনান এ অনুষ্ঠানে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর