শিরোনাম
শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সীমানা ছাড়িয়ে রুনা লায়লা

সীমানা ছাড়িয়ে রুনা লায়লা

রুনা লায়লা, যিনি নিজেই নিজের বিশেষণ! এক নামেই সংগীত দুনিয়ায় যার পরিচয়। রুনা লায়লার তুলনা যেন শুধু তিনিই। জনপ্রিয়তা, সফলতা, প্রাপ্তির সঙ্গে এতটা বছর পাড়ি দিয়ে তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য কম সংখ্যক মানুষেরই জোটে। আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ তারকার জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

৭২ বসন্তে জীবন্ত কিংবদন্তি

১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন রুনা লায়লা। জীবনের ৭১টি বসন্ত পেরিয়ে শুক্রবার ৭২ বছরে পা দিলেন তিনি।

 

বয়স তো কেবল ১৭!

শিল্পী হিসেবে আবির্ভাব ৬০-এর দশকেই। সংগীত জীবনের ৫৮ বছর পার করেছেন এই কিংবদন্তি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে তাঁর বয়স আর বাড়ছে না, কমছেও না? রুনা লায়লার দাবি, ‘আমার বয়স তো ১৭! এখনো এডাল্ট হইনি। এইটটিন্থ হলে পরে জানাব। আমি খুবই সাধারণ মানুষ। অনেকেই মনে করে আমি নাক উঁচু টাইপের, কারও সঙ্গে কথা বলি না। তবে হ্যাঁ, আমি রিজার্ভ। সবার সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু যাদের সঙ্গে মিশি, পছন্দ করি তাদেরকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।’

 

শৈশব কাটে পাকিস্তানের লাহোরে

রুনা লায়লার বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা। মা আনিতা সেন ওরফে আমেনা লায়লা ছিলেন সংগীতশিল্পী। তার মামা সুবীর সেন ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী। রুনা লায়লার যখন আড়াই বছর বয়স তখন তার বাবা রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে চলে যান। সেই সূত্রে তার শৈশব কাটে লাহোরে।

 

গান নয়, প্রথমে শিখেছিলেন নাচ

গান নয়, প্রথমে শিখেছিলেন নাচ। করাচিতে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করেন মা আমেনা লায়লা। চার বছরে শিখেছিলেন কত্থক আর ভরতনাট্যম।

 

বোনের কল্যাণে গানে

বড় বোন দিনা লায়লা গান শিখতেন। তাঁকে গান শেখাতে বাসায় আসতেন ওস্তাদ। রুনার বয়স তখন চার কি পাঁচ। ওস্তাদজির শেখানো গান মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। গুনগুন করে গাইতেনও। মেয়ের প্রতিভায় মুগ্ধ মা-বাবা। তখনই রুনাকে গান শেখানো শুরু করেন। গানে তাঁর প্রথম শিক্ষক আবদুল কাদের ও হাবিব উদ্দিন আহমেদ। পরে গজল শিখেছেন মেহেদী হাসানের বড় ভাই ওস্তাদ গোলাম কাদিরের কাছে।

বোনের বদৌলতেই প্রথম মঞ্চে ওঠেন। করাচিতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। দিনার গান করার কথা ছিল। দিনা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে আয়োজকরা রুনাকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান। তখন রুনার বয়স ছয়। সেদিন শাস্ত্রীয়সংগীত গেয়েছিলেন রুনা। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছিল শ্রোতারা।

 

উর্দু ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক

১৯৬৫ সালের জুন মাসে ‘জুগনু’ ছবিতে প্রথম গাইলেন ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। রুনার বয়স তখন ১২। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। সংগীত পরিচালক মনজুর হোসেন রেকর্ডিংয়ের আগে এক মাস প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। দ্বিতীয় গানটিও একই ছবির। এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলান শর্মিলী আহমেদ।

 

বলিউডের ছবিতে

বলিউডের বেশ কয়েকটি ছবিতে গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। ‘এক সে বড়কার এক’ ছবিতে কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে টাইটেল গানে কণ্ঠ দেন। বলিউডে তাঁর বেশির ভাগই একক গান। কুমার শানুর সঙ্গেও অ্যালবাম করেছেন। সর্বশেষ গেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘অগ্নিপথ’ ছবির ‘আলীবাবা মিল গ্যায়া চল্লিশ চোর সে’ গানটি। বলিউডে তার গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘ও মেরা বাবু চেইল চেবিলা’। এর সংগীত পরিচালনা করেন এম. আশরাফ। পাকিস্তানের ‘মান কি জিত’ (১৯৭২) ছবির এ গানটি ব্যবহার হয় বলিউডের ‘ঘর দুয়ার’ (১৯৮৫) ছবিতে।

 

বাংলা গানে যেভাবে

প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং করেন পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে গান করার জন্য আমন্ত্রণ পান রুনা। নজরুল ইসলাম আর সংগীত পরিচালক সুবল দাস ‘স্বরলিপি’ ছবির গান রেকর্ডিং করতে যান লাহোরে। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছবির ছয়টি গান রেকর্ড করলেন। লাহোরের বারি স্টুডিওতে প্রথম রেকর্ড করা হয় ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’।

 

অবশেষে বাংলাদেশে

মা-বাবার সঙ্গে দেশে আসেন ১৯৭৪ সালে। এরপর সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ ছবিতে গান করেন।

 

গিনেস বুকে রুনা

পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুরে ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন তিনি।

 

সুপার রুনা

১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর রুনার গাওয়া বাপ্পী লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে ‘সুপার রুনা’ অ্যালবাম। প্রথম দিনেই ১ লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক।

 

১০ হাজারেরও বেশি গান

লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক- সব ধাঁচের গানই গেয়েছেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিসহ ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।

 

অগণিত পুরস্কার-সম্মাননা

স্বাধীনতা পুরস্কারসহ রুনা লায়লা। পেয়েছেন রেকর্ড সাতবার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। তিনি ভারত থেকে পান সায়গল পুরস্কার, সংগীত মহাসম্মান পুরস্কার, তুমি অনন্যা সম্মাননা এবং দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা। পাকিস্তান থেকে পেয়েছেন নিগার পুরস্কার।

 

গায়কীতে স্বতন্ত্র ঢং

সংগীতজীবনের শুরু থেকেই তিনি স্বতন্ত্র ঢং তৈরি করেছেন। বেশির ভাগ গায়িকা একইভাবে দাঁড়িয়ে গাইতেন। তাঁর গানের পরিবেশনা দেখে এই চিত্রটা পাল্টায়। অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করেন, এখনো করছেন।

 

চলচ্চিত্রে অভিনয়

চাষী নজরুল ইসলামের ‘শিল্পী’তে আলমগীরের বিপরীতে অভিনয় করেন।

 

অনন্য এক ফ্যাশন আইকন

তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্যাশন আইকনেও পরিণত হয়েছেন তিনি। তাঁর সাজসজ্জা, পোশাক, গাওয়ার ভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছুই অনুসরণীয়।

 

অন্তরে বাংলাদেশ

রুনা সব সময়ই বলেন, ‘সবার আগে আমার দেশ। আমার বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রাধান্য আগে। যেখানেই যাই, বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করি।’

সর্বশেষ খবর