মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঢাকাই চলচ্চিত্রে নারী নির্মাতা কেন কম

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন হয় ১৯৭৫ সালে। ৪৮ বছরের মাথায় এসে এ পর্যন্ত মাত্র দুজন নারী নির্মাতা শ্রেষ্ঠ পরিচালক ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঢাকাই চলচ্চিত্রে নারী নির্মাতা কেন কম

ঢাকাই চলচ্চিত্রে নারী নির্মাতারা বৈষম্যের শিকার, এ অভিযোগ খোদ নারী নির্মাতাদের। এছাড়া চলচ্চিত্রাঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও তাঁদের নানারকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এর দুটি উদাহরণ অবধারিতভাবে তুলে ধরা যায়, যেমন- প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার কোহিনূর আক্তার সুচন্দা ২০০৫ সালে সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেন ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রটি। এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নানা শাখায় পুরস্কৃত হয় এবং নির্মাতা হিসেবে এ ছবির জন্য সেরা নির্মাতার পুরস্কার লাভ করেন সুচন্দা। অথচ এরপর তিনি ‘বরফ গলা নদী’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণে একাধিকবার সরকারি অনুদান চেয়ে পাননি। দ্বিতীয় বিষয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের ৪৮ বছরের মাথায় এসে এ পর্যন্ত মাত্র দুজন নারী নির্মাতা শ্রেষ্ঠ পরিচালক ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে সুচন্দা ছাড়া অন্যজন হলেন ২০২২ সালের জাতীয় পুরস্কারে সেরা নারী নির্মাতা হন ‘শিমু’ ছবির জন্য রুবাইয়াত হোসেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রে নারীদের এমন অবহেলিত অবস্থানের কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার জন্যই শুধু নির্মাণে কোনো নারী এগিয়ে আসতে চান না বলে উল্লেখ করেছেন কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। তাই ঢালিউডে চলচ্চিত্র নির্মাণে নারীদের খুব একটা দেখা যায় না। কেউ কেউ দুই-একটি সিনেমা নির্মাণ করে হারিয়ে যান। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রপরিচালক মনজন আরা বেগম রেবেকা, জাহানারা ভূঁইয়া, সুজাতা আজিম, সুমিতা দেবী, কোহিনূর আক্তার সুচন্দা, রোজী আফসারী, কবরী, সামিয়া জামান, মাতিয়া বানু শুকু, হৃদি হক, মারিয়া তুষার, শামীম আখতার, শাহনেওয়াজ কাকলী, রওশন আরা নিপা, মেহের আফরোজ শাওন, মাহবুবা ইসলাম সুমী, প্রীতি দত্ত, ক্যাথরিন মাসুদ, জেসমিন আক্তার নদী, তানিয়া আহমেদ, মৌসুমী, রোজিনা এবং সর্বশেষ যুক্ত হলেন অরুণা বিশ্বাস। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব নারী নির্মাতার ছবির নির্মাণশৈলী, গল্প বলার আঙ্গিক, লোকেশন নির্বাচনসহ নানা কারণে নারী নির্মাতারা বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ যে কোনো পুরস্কারেই এখন এগিয়ে আছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আক্তার নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও নিয়মিত সিনেমা নির্মাণ করে যাচ্ছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, চলচ্চিত্রে নারীদের চলার পথ মসৃণ নয়। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি নারী নির্মাতা হিসেবে আমার সংগ্রামটা একটু বেশি করতে হয়। এখন পর্যন্ত আটটি সিনেমা নির্মাণ করেছি। এর মধ্যে তিনটি নিজেই প্রযোজনা করেছি। অর্থলগ্নিকারী সাধারণত নারী নির্মাতা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করাতে চান না। তারা হয়তো মনে করেন নারীদের মেধা কম, কাজ ধীরগতিতে হবে, ভালো কিছু নির্মাণ করতে সক্ষম হবে না। তারা লোকসানে পড়বে। অথচ আমি নারী নির্মাতা হিসেবে পুরুষ নির্মাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি।’ নারী নির্মাতাদের মধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নার্গিস আক্তারের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেঘলা আকাশ’ ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার অর্জন করেন। পরবর্তীতে তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘যৈবতী কন্যার মন’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায়। নির্মাতা সামিয়া জামানের ‘রানী কুঠির বাকি ইতিহাস’ চলচ্চিত্রটিও দর্শকগ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। আর শাহনেওয়াজ কাকলীর ‘উত্তরের সুর’ ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’ আটটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পে নারী-পুরুষের বৈষম্য রয়েই গেছে বলে মনে করেন চলচ্চিত্র পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন। শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় এক যুগ। আমি দেখেছি দেশে নারী নির্মাতা একেবারে হাতেগোনা। চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁরা বৈষম্যের শিকার। আমার মনে হয়েছে বৈষম্যের এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বেশি করে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আমরা যাঁরা আছি, তাঁদের সঙ্গে আরও মেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু তার আগে দরকার মেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণ শিখানো। শুধু শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কারই নয়, রুবাইয়াত হোসেনের চলচ্চিত্র শিমু সর্বাধিক চারটি পুরস্কার জিতেছে ২০২২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের। দৃঢ়চেতা নারী পোশাকশ্রমিকদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প বলা হয়েছে রুবাইয়াত হোসেনের তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘শিমু’ বা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এ। তাঁর প্রথম ছবি মেহেরজান মুক্তি পায় ২০১১ সালে এবং দ্বিতীয় ছবি আন্ডার কনস্ট্রাকশন মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। ওই বছর শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জন্য রুবাইয়াত হোসেন পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জার জন্য পুরস্কার পায় ছবিটি। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদৃত ও পুরস্কৃত হয়েছে ছবিটি। ফ্রান্সের সেইন্ট জঁ দ্য-লুজ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেন রিকিতা নন্দিনী শিমু। ইতালির টোরিনো বা তুরিন চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছে ইন্টারফেদি পুরস্কার এবং ফ্রান্সের এমিয়েন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিয়েছে সেরা দর্শক পুরস্কার ও জুরি পুরস্কারসহ তিনটি পুরস্কার। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, কানাডা ও পর্তুগালের ৭০টি সিনেমা হলে বাণিজ্যিকভাবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নামে মুক্তি পায় ছবিটি। এরপর টানা ১৪ সপ্তাহ ধরে ফ্রান্সের শতাধিক সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয় ছবিটি। ২০২০ সালে আমেরিকার বিভিন্ন হলে প্রদর্শনের পর ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে দেখানো হয় ম্যাক্সিকো, চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, জাপান ও জার্মানির সিনেমা হলে। ঢালিউডে প্রথম নারী নির্মাতা হিসেবে সবার আগে আসে রেবেকার নামটি। ১৯৭০ সালে ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। তখন সিনেমাটি বোদ্ধামহলে প্রশংসিত হয়। কোহিনূর আক্তার সুচন্দা আশির দশকে প্রথমে ‘তিন কন্যা’ ছবিটি প্রযোজনা করেন। ১৯৯৯ সালে পরিচালনা করেন ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ নামের একটি ছবি। এরপর ‘প্রেমপ্রীতি’ নামেও আরেকটি ছবি পরিচালনা করেন। ২০০৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন জহির রায়হানের উপন্যাস অবলম্বনে সরকারি অনুদানে ‘হাজার বছর ধরে’ ছবিটি। এ চলচ্চিত্রটি দর্শকদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়। পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ নির্মাতাসহ বেশ কয়েকটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে ছবিটি। নার্গিস আক্তার ২০০২ সালে ‘মেঘলা আকাশ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন। ২০০৫ সালেও বহুবিবাহের অন্যায়কে নির্দেশ করে সেলিনা হোসেনের গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘চার সতীনের ঘর’। ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মেঘের কোলে রোদ’ সিনেমার গল্প আবর্তিত হয় এইডস সম্পর্কে সচেতনতাকে উদ্দেশ্য করে। ২০১০ সালে নির্মাণ করেন ‘অবুঝ বউ’ সিনেমাটি। এটি ৩৫তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা চিত্রনাট্য, সুর ও সম্পাদনার তিনটি পুরস্কার ঘরে তোলে। এরপর মুক্তি পায় তাঁর ‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবিটি। ২০১০ সালে রুবাইয়াত হোসেন নির্মাণ করেন ‘মেহেরজান’ চলচ্চিত্র। ছবিটি দেশে আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি বিদেশে পুরস্কৃতও হয়। এরপর তিনি ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নামে দুটি ছবি নির্মাণ করেন এবং পুরস্কৃত হন। শাহনেওয়াজ কাকলী ২০১২ সালে নির্মাণ করেন ‘উত্তরের সুর’। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এরপর ২০১৫ সালে শেখ জহুরুল হকের গুণ উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে কাকলী নির্মাণ করেন নদীজন। চিত্রনায়িকা মৌসুমী ২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ছোট গল্প ‘মেহেরনেগার’ অবলম্বনে ২০০৫ সালে মৌসুমী নির্মাণ করেন ‘মেহের নিগার’। মেহের আফরোজ শাওন ২০১৬ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘কৃষ্ণপক্ষ’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র। সংবাদকর্মী থেকে রীতিমতো পরিচালক হয়ে যান সামিয়া জামান। ২০০৬ সালে মুক্তি পায় তাঁর নির্মিত ‘রানী কুঠির বাকি ইতিহাস’। এ চলচ্চিত্রটিও দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পায়। পাশাপাশি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ২০১৪ সালে সামিয়া জামান নির্মাণ করেন তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আকাশ কত দূরে’। এছাড়া বর্তমানে ‘আজব কারখানা’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি। অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদ ২০১৭ সালে নির্মাণ করেন ‘ভালোবাসা এমনই হয়’ ছবিটি। চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’ ও ‘প্রহেলিকা’ ছবি দুটি বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়। রওশন আরা নীপা ২০১৫ সালে নির্মাণ করেন ‘মহুয়া সুন্দরী’ ছবিটি। এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা আশির দশকে ‘ফুলশয্যা’ ও ‘আগমন’ নামে দুটি ছবি প্রযোজনা করেন। সর্বশেষ তাঁর প্রযোজিত ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ সেরা ছবিসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বেশ কয়টি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। পরিশেষে উদ্বেগের কথা হলো ঢাকাই চলচ্চিত্রে এত কমসংখ্যক নারী নির্মাতার আগমন ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন সত্ত্বেও নারীদের প্রতি বৈষম্য ও নানা প্রতিকূলতার কারণে নারী নির্মাতার সংখ্যা এখানে নিতান্তই স্বল্প।

সর্বশেষ খবর