মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
ভারতের লেখিকা শ্রায়ানা ভট্টাচার্যের জরিপ

শাহরুখকে কেন মেয়েদের এত পছন্দ

আলাউদ্দীন মাজিদ

শাহরুখকে কেন মেয়েদের এত পছন্দ

বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের ভক্তদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাটাই বেশি। দেখা গেছে, তাঁর অভিনীত রোমান্টিক ঘরানার ছবি ‘দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ কিংবা ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’, অথবা ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ মেয়ে দর্শকদেরই বেশি পাগল করেছে। কিন্তু কেন? বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহরুখের মেয়ে দর্শকদের কথায়- ‘নায়ক হিসেবে শাহরুখ ‘আকর্ষণীয়’, যাঁর সঙ্গে নিজেকে মেলানো যায়। তিনি ‘মজা’ করতে পারেন, বুদ্ধিদীপ্ত ‘ব্যঙ্গ’ করতে ওস্তাদ। সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে তাঁর কথা প্রকাশ পায় এবং খ্যাতি এবং অর্থের জন্য তাঁর যে চেষ্টা তা নিয়ে তাঁর কোনো ‘লজ্জা’ বা কুণ্ঠা নেই। শাহরুখ খুব ‘ম্যাচো’ নায়ক হয়তো নয়, কিন্তু সংবেদনশীল এবং যে নারীর প্রেমে তিনি পড়েন তাঁকে পাওয়ার জন্য যে কোনো কিছু করতে তিনি প্রস্তুত। ‘মেয়েদের জন্য তাঁর যে ভালোবাসা, সে জন্যই আমরা তাঁকে ভালোবাসি।’ জানা গেছে, ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা শ্রায়ানা ভট্টাচার্য শাহরুখ খানের ওপর একটি বই রচনা করতে গিয়ে শাহরুখ সম্পর্কে তাঁর ডজন ডজন নারী ফ্যানকে এই প্রশ্ন করে প্রায় একই উত্তর পেয়েছেন। লেখিকা শ্রায়ানা বলেন, ‘স্বপ্ন, উদ্বেগ, প্রেম এবং সঙ্গী পছন্দ নিয়ে মেয়েদের যে নিরন্তর লড়াই, যন্ত্রণা- তার সঙ্গে যেন কোথাও তাঁদের শাহরুখপ্রীতির যোগসূত্র রয়েছে।’ শ্রায়ানা ভট্টাচার্য প্রায় ২০ বছর ধরে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময় শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা নিয়ে উত্তর ভারতের বহু নারীর সঙ্গে খোলামেলা আলাপচারিতা থেকে এসব উত্তর পেয়েছেন। এসব নারীর মধ্যে বিবাহিত, অবিবাহিত, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান- সব ধরনের মানুষ আছে। তাঁদের অনেকে পরিবারে সুখী, অনেকে অসুখী, অতৃপ্ত। তাঁদের মধ্যে অনেক শ্রমজীবী নারীও রয়েছেন। একটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল, তাঁরা সবাই শাহরুখ খানের ফ্যান। ২০০৬ সালে পশ্চিম ভারতের একটি বস্তিতে আগরবাতি তৈরির কারখানার নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই লেখক। জিজ্ঞাসা করেন কোন বলিউড নায়ক তাঁদের সবচেয়ে প্রিয়। তাঁরা সোৎসাহে বলেন, ‘শাহরুখ খান’। সাধারণ একটি আক্ষেপ এই নারীরা করেছেন- ‘কেন আরও বেশি পুরুষ শাহরুখের মতো হয় না।’ এই নারীরাই তাঁকে তারকা বানিয়েছেন। আর এর পেছনে ছিল তাঁদের নিজেদের নিত্যদিনের বাস্তবতা, তাঁদের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, হতাশা, বলেন লেখিকা ভট্টাচার্য। পর্দায় নায়িকার প্রতি খানের শতভাগ নিষ্ঠা, মনোযোগ নারীদের আকর্ষণ করে।

অনেক চরিত্রে তিনি যেভাবে সম্পর্কের পরিণতি, অনিশ্চয়তা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ দেখিয়েছেন তাতে আকৃষ্ট হয়েছেন নারীরা। কারণ তাঁদের নিজেদের জীবন নিয়েও তাঁরা সবসময় অনিশ্চয়তায় ভোগেন। পর্দায় আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে শাহরুখ অনেক সময় বেসামাল হয়ে হুহু করে কাঁদেন। যেটা বলিউডে বেশ বিরল। তা পছন্দ করেন নারীরা। কারণ তাঁরা দেখেন শাহরুখ তাঁর আবেগ প্রকাশ করতে, নারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে লজ্জা পান না। ‘আমি স্বপ্ন দেখি কাভি খুশি কাভি গাম ছবিতে শাহরুখ যেভাবে কাজলের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁকে স্পর্শ করেছেন আমার সঙ্গে কোনো পুরুষ যদি তেমন করত। কিন্তু আমার স্বামী এতই রুক্ষ’, বলেন মুসলিম এক নারী পোশাক শ্রমিক। ধনী, অভিজাত পরিবারের অসুখী বিবাহিতা এক নারী বলেন, তিনি তাঁর ছেলেদের ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে বড় করতে চান। তাঁর কাছে ভালো মানুষের সংজ্ঞা হলো শাহরুখ যেমন আমাদের মধ্যে যে ভরসা এবং ভালোবাসার বোধ তৈরি করে, তাঁর ছেলেরাও যেন তাঁদের স্ত্রীদের মনে একই অনুভূতি তৈরি করতে পারে। পর্দায় খানের ছোট ছোট জিনিস তাঁদের অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আসলেই নারীদের মধ্যে শাহরুখ বিশেষ জনপ্রিয়। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিটি শাহরুখ খানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিগুলার অন্যতম। এটি সম্ভবত বলিউডের সবচেয়ে সফল রোমান্টিক চলচ্চিত্র। ওই ছবি সম্পর্কে শাহরুখের এক তরুণী ফ্যানের মা আমাকে যে কথা বলেন তা আমি কখনো ভাবিনি, লক্ষ্যও করিনি। ‘আমি প্রথমবারের মতো ওই ছবিতে দেখলাম নায়ক ছুরি দিয়ে গাজর ছিলছে। পরিবারের নারীদের সঙ্গে নায়কের এত হইচই, এত সময় কাটানোর ব্যাপার আমি আগে কোনো সিনেমায় দেখিনি।’ ওই নারীর মতে- এই ব্যাপারটি ছিল অসামান্য রোমান্টিক। নারী ফ্যানরা যে শাহরুখের প্রতি কোনো যৌন আকর্ষণ বোধ করেন না, তা নয়। সে কথা তাঁরা প্রকাশও করেছেন। কিন্তু সেটি ছাড়াও তাঁকে পছন্দের কারণ হিসেবে ওই নারীরা আরও অনেক কিছু বলেছেন। প্রতিদিনের অবিচার, লড়াই এবং হৃদয় ভাঙার বেদনার মধ্যে খান অনেক নারীর জন্য এক ধপ্রণর স্বস্তি, উপশম। তাঁর মতো একজনকে নারীরা যে বিয়ে করতে চাইতেন তার কারণ এই নয় যে, তিনি একজন বলিউড তারকা। তার প্রধান কারণ তিনি একজন ‘সহানুভূতিশীল বিবেচক পুরুষ’। একজন বিবেচক পুরুষ নারীকে কাজ করার সুযোগ দেয়, টাকা জমানোর সুযোগ দেয়। অন্তত স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা পূরণ না করলেও তা পায়ে দলে দেয় না। এ কারণে তাঁরা শাহরুখের ছবি দেখতে সিনেমা হলে গিয়ে হামলে পড়েছেন। ভট্টাচার্যের বইয়ে এমন এক সরকারি কর্মকর্তার ভাষ্য রয়েছে, যিনি তরুণী বয়সে লুকিয়ে শাহরুখের ছবি দেখতে গিয়ে মায়ের হাতে মার খেয়েছিলেন। এক গার্মেন্ট শ্রমিকের কথা রয়েছে, যাকে লুকিয়ে শাহরুখের ছবি দেখার জন্য ছোট ভাইদের মুখ বন্ধ রাখতে উৎকোচ দিতে হয়েছে। এক গৃহকর্মী যিনি রবিবারের গির্জায় প্রার্থনা বাদ দিয়ে টিভিতে শাহরুখের ছবি দেখার জন্য পাদ্রির কাছে মিথ্যা অজুহাত দিয়েছেন। লেখিকা ভট্টাচার্য লিখেছেন, এসব নারী হয়তো খুব বেপরোয়া বা সাহসী নয়, কিন্তু এ ধরনের পছন্দ প্রকাশ করে তাঁরা তৃপ্তি পান, তাঁদের কাছে এটা এক ধরনের বিদ্রোহ। বিছানার নিচে পছন্দের নায়কের পোস্টার রেখে দেন তাঁরা। পর্দায় তাঁর গাওয়া গান শোনেন, সেই গানের সঙ্গে তাঁরা নাচেন। তাঁর ছবি দেখে তাঁরা বোধ করেন কোন ধরনের জীবন তাঁরা চান বা চেয়েছিলেন। যেমন- যে সরকারি চাকুরের কথা বইয়ে আছে, তিনি একসময় পণ করেছিলেন তিনি এমন এক জীবন তৈরি করবেন যেখানে শাহরুখ খানের ছবি দেখতে কারও কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে না। একজন নারী বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন কারণ চুরি করে খানের ছবি দেখতে যাওয়ার কারণে তাঁর পরিবার তড়িঘড়ি করে এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিল যে ছেলে শাহরুখ খানকে পছন্দ করে না। ওই নারী এখন একজন বিমানবালা এবং এমন একজনকে বিয়ে করেছেন যার সঙ্গে তিনি শাহরুখের মিল খুঁজে পান, ‘একই ধরনের আবেগ’ বোধ করেন। একজন নারী আমাকে বলেছেন টিভিতে শাহরুখের সাক্ষাৎকার দেখে তিনি ভালো ইংরেজি শিখেছেন। এমনটাই উল্লেখ করে লেখিকা ভট্টাচার্য বলেন শাহরুখ তাঁর সময়ের একজন আইকন, ‘এখনকার তরুণীরা খানকে বিয়ে করতে চান না। তাঁরা নিজেরা খান হতে চান। তাঁরা তাঁর মতো স্বাধীনতা এবং সাফল্য অর্জন করতে চান।’

সর্বশেষ খবর