মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বলিউডে প্রাণ ফিরেছে যেভাবে

আলাউদ্দীন মাজিদ

বলিউডে প্রাণ ফিরেছে যেভাবে

জওয়ানে শাহরুখ খান

গত রবিবার রাতে কলকাতার একটি সিনেমা হলের চিত্র ভারতীয় ‘জি সিনেমা’ অনলাইনের সাংবাদিক অনুষ্টুপ রায় বর্মণ এভাবেই তুলে ধরেছেন। তার বর্ণনায়- ‘রাত ১১টা। সল্টলেকের অফিসপাড়ায় এক মাল্টিপ্লেক্সের সামনে উপচে পড়ছে ভিড়। চারদিকে  দেখা যাচ্ছে সারি সারি কালো মাথার ঢল। চলন্ত সিঁড়ি দাঁড় করিয়ে দিতে হয়েছে যাতে মানুষ দাঁড়াতে পারে। না না, কিং খান বা ভাইজান নয়। ভিড় অ্যানিমেলের। হ্যাঁ সন্দীপ রেডি ভাঙার অ্যানিমেল। হ্যাঁ রণবীর কাপুরের অ্যানিমেল এবং অবশ্যই ববি দেওলের অ্যানিমেল। কলকাতা শহরে রণবীর কাপুরের এত  ক্রেজ ছিল না, সুদূর অতীতে তার কোনো সিনেমা নিয়ে এত মাতামাতি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই শহর  যেমন প্রাচীন তেমনই একটু প্রাচীনপন্থি এই শহরের সিনেমা ভালো লাগা। ছোটবেলা থেকে সিঙ্গেল স্ক্রিনের সামনে শাহরুখ থেকে সালমানের পাহাড়প্রমাণ কাটআউটে মালা পরিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া দর্শক হঠাৎ চকলেট হিরোর প্রেমে কবে পড়ল? হ্যাঁ, রণবীর ফিরলেন বীরের বেশে। সাম্প্রতিক সময়ে শাহরুখ আর সানি দেওলের পথে হেঁটে রণবীরও প্রাণ ফিরিয়ে আনলেন মৃতপ্রায় বলিউড সাম্রাজ্যের। কমপক্ষে ২০২০ সালে অতিমারি করোনার ছোবল আর এর আগে পরে দক্ষিণী সিনেমার দাপটে যেন মুখ থুবড়ে পড়েছিল বলিউড। বাঘা নির্মাতা আর আর্টিস্ট, সবার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিল ক্রমে। সালমান শাহরুখের মতো দুর্ধর্ষ শিল্পীরা বলিউডের বিধ্বস্ততায় বাধ্য হয়ে দক্ষিণী অভিমুখে যাত্রার সিদ্ধান্ত একরকম নিয়েই ফেলেছিলেন। বলিউডের দেয়ালে কান পাতলেই শুধু  শোনা যেত হাহাকার আর হতাশা। অবস্থা যখন একবারেই নাভিশ্বাসে তখনই বলা যায় বিধাতার কৃপায়  যেন বলিউডের খরা জমিনে নামল স্বস্তির বৃষ্টি। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে মুক্তি পেল শাহরুখ খান-দিপীকা অভিনীত ‘পাঠান’ ছবিটি। মুক্তির পর পরই এই ছবির সাজ সাজ রব ফিরিয়ে দিল বলিউডের হারানো ঐতিহ্য। ২২৫ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত এই ছবিটি বিশ্বজুড়ে আয় করল ১০৫০. ৩০ কোটি রুপি। দীর্ঘদিন পর বলিউডে ছবির আবার এমন অবিশ্বাস্য সাফল্যে দুনিয়াজুড়ে দর্শক আর সিনে বিশ্লেষকদের তাক লাগিয়ে দিল। এখানেই শেষ নয়। এরপর এলো সানি দেওল অভিনীত ‘গাদার-টু’ ছবিটি। চলতি বছরের ১১ আগস্ট বিশ্বজুড়ে মুক্তি পেয়ে এই ছবিটি যেন বলিউডের চিরচেনা সাফল্যের চেহারাকে আরেক বার তুলে ধরল। ৬০০ কোটি রুপির এই ছবিটির বিশ্বব্যাপী আয় ছিল ৬৯১১ কোটি রুপি। এরপর আবার এলো শাহরুখ ঝড়  ‘জওয়ান’। চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড রিলিজকৃত এই ছবি নির্মাণ হয়েছিল ৩০০ কোটি রুপিতে। আর এর তুলকালাম ঝড় এখন পর্যন্ত ভারতীয় বক্স অফিসে জমা করে দিয়েছে ১১৪৪.২৩ কোটি রুপি। এরপর আর বিশ্বাস করতে দ্বিধা ছিল না বলিউড এখন শুধু বিজয়ের রথে চড়বে। এই বিশ্বাসকেই আবার সত্যে পরিণত করল ১ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া রণবীর কাপুর অভিনীত ‘অ্যানিমেল’ ছবিটি। ১০০ কোটি রুপির এই ছবি মুক্তির গত তিন দিনে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫০ কোটি রুপি আয় করে রীতিমতো বলিউড বক্স অফিসকে প্রায় তছনছ করে দিয়েছে। চলতি বছর ধারাবাহিকভাবে বলিউডি ছবির এমন সাফল্যের তান্ডবে আবারও প্রাণ ফিরেছে এই সাম্রাজ্য। আবারও আশায় বুক বেঁধে পথ চলতে শুরু করেছে বলিউডের বাঘা নির্মাতা আর শিল্পীরা। এর বাইরে আরও অনেক সিনেমা ভালো আয় করেছে। ১১ আগস্ট মুক্তি পাওয়া সালমান খানের ৩০০ কোটি রুপির ছবি ‘টাইগার থ্রি’ এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ কোটি রুপি আয় করেছে। গত ২৫ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে আয়ুষ্মান খুরানা অভিনীত ‘ড্রিম গার্ল টু’। ৬০  কোটি রুপির এ সিনেমা ভারতে আয় করেছে প্রায় ১২৩ কোটি রুপি। মহামারি-পরবর্তী সময়ে এ রকম একটি লো বাজেট সিনেমার ১০০ কোটি রুপি আয় পার করা অসম্ভব ব্যাপার। বিশেষত বলিউডের সিনেমা তা পারছিল না। কিন্তু পাঠান-জ্বর দিয়ে শুরু হওয়া বছরে বলিউড বেশকিছু সিনেমা  পেয়েছে, যা আশাতীত আয় করেছে। অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘ওএমজি টু’ আয় করেছে ১৭৮ কোটি রুপি। করণ জোহরের ‘রকি আউর রানি কি  প্রেম কাহানি’ আয় করেছে ১৮০  কোটি রুপি। সমালোচিত হলেও আদিপুরুষ ভারত থেকে আয় করেছে  মোট ৩৪২ কোটি রুপি। যদিও বাজেটের অর্ধেকই তুলেছে সিনেমাটি। শত কোটির ঘর পার করেছে ‘জারা হটকে জারা বাচকে’র মতো লো  প্রোফাইল সিনেমা। বিতর্কিত ‘দ্য কেরালা  স্টোরি’ আয় করেছে ২৮৬ কোটি রুপি। অজয়  দেবগন অভিনীত ‘ভোলা’ আয় করেছে ১০৮ কোটি রুপি। রণবীর ও শ্রদ্ধা কাপুর অভিনীত ‘তু ঝুঠি ম্যায় মক্কার’ বৈশ্বিক ২  কোটি পার করার পাশাপাশি ভারতে আয় করেছে ১৭৫  কোটি রুপি। সিনেমার বাজেট ছিল ৭০  কোটি। সে হিসেবে  দেখা যাচ্ছে শতকোটি পার করা  বেশকিছু সিনেমা আছে। এ বছর বলিউডের হাতে আছে আরও  বেশকিছু সিনেমা। এর মধ্যে শাহরুখ খানের ‘ডাঙ্কি’ নিয়ে আশাবাদী সবাই। শাহরুখের ‘পাঠান’ এর আগে বলিউডের চিত্র ছিল বড়ই করুণ। ভারতের বক্স অফিসে বলিউডের একের পর এক বড় বাজেটের ছবি মুখ থুবড়ে পড়ছে। বিপরীতে  তেলুগু, তামিল ও কন্নড় ছবিগুলো দাপিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। গত বছরে বলিউডে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ৫০টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে ব্যবসাসফল মাত্র চারটি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’, ‘ভুলভুলাইয়া ২’, ‘গাঙ্গুবাঈ কাথিওয়াড়ি’ ও ‘যুগ যুগ জিও’। সারা ভারতে ওই বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করা সেরা ১০ ছবির তালিকায় আছে মাত্র তিনটি বলিউড ছবি। সেরা দশে জায়গা হয়নি ‘যুগ যুগ জি’ওর। বাকি সাতটিই দক্ষিণ ভারতে নির্মিত ছবি। এর মধ্যে তিনটি তামিল এবং দুটি করে আছে তেলুগু ও কন্নড় ছবি। করোনার আগেও হিন্দি ছবির দাপট ছিল বক্স অফিসে। করোনার পর সব  কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল! একে একে বড় বাজেট ও বড় তারকার ছবি হোঁচট খেল। অমিতাভ বচ্চনের ‘ঝা’, অমিতাভ-অজয়ের ‘রানওয়ে ৩৪’, অক্ষয় কুমারের ‘বচ্চন পান্ডে’ ও ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’, ঋষি কাপুরের ‘শর্মাজি নমকিন’, জন আব্রাহামের ‘অ্যাটাক’ ও ‘এক ভিলেন রিটার্নস’, শহীদ কাপুরের ‘জার্সি’, রণবীর সিংয়ের ‘জয়েশভাই জোরদার’, কঙ্গনা রানাওয়াতের ‘ধকড়’, টাইগার শ্রফের ‘হিরোপান্তি ২’, আয়ুষ্মান খুরানার ‘অনেক’, আর মাধবনের ‘রকেট্রি দ্য নাম্বি ইফেক্ট’, তাপসী পান্নুর ‘সাবাশ মিঠু’ এবং রণবীর কাপুরের ‘শমশেরা’র ব্যর্থতা রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছে বলিউড প্রযোজক-পরিচালকদের। অথচ দক্ষিণ ভারতের তেলুগু, তামিল, কন্নড় ভাষায় নির্মিত ছবিগুলো  দেখতে হিন্দিভাষী দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সারা ভারতে ঝড় তোলা তেলুগু ছবি ‘পুষ্পা দ্য রাইজ’-এর প্রভাব এ বছরও অব্যাহত বক্স অফিসে। কন্নড় ছবি ‘কেজিএফ-চ্যাপ্টার টু’ হাজার  কোটি আয় করে ভারতের সর্বাধিক ব্যবসা করা ছবির তালিকার শীর্ষে। পরের স্থানে এস এস রাজামৌলির  তেলুগু ছবি ‘আরআরআর’ (৯৪৪ কোটি রুপি), তৃতীয় স্থানে তামিল ছবি ‘বিক্রম’ (৪৮০ কোটি রুপি)। দক্ষিণী এই ছবিগুলো স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি হিন্দিসহ ভারতের পাঁচ ভাষায় মুক্তি  পেয়েছিল। এই পথে হাঁটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বলিউড। গত বছরের ২২ জুলাই মুক্তি পাওয়া ‘শমশেরা’ তার সর্বশেষ নজির। এ সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ‘বিক্রান্ত রোনা’ চার দিনে ১০০ কোটি রুপি আয় করার পর পঞ্চম দিনে ৭০ শতাংশ ব্যবসা  নেমে গেছে। একই দিনে মুক্তি পাওয়া বলিউড ছবি ‘এক ভিলেন রিটার্নস’-এর দ্বিগুণ আয় করেছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত বলিউড ডুবে ছিল চরম হতাশায়। এখন ফের আশার আলো জ্বলে উঠল।

সর্বশেষ খবর