রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এখনো আলোচনায় ‘ওরা ১১ জন’

এখনো আলোচনায় ‘ওরা ১১ জন’

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ এর প্রযোজক হিসেবে আজো ইতিহাস হয়ে আছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা, সংগঠক এক কথায় সব ক্ষেত্রেই সফল তিনি। অন্যদিকে ছবিটি পরিচালনা করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিটির নেপথ্যের যত গল্প তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ছিল চ্যালেঞ্জ

১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশে তখন সমস্যার অন্ত নেই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে নয় মাস লড়াইয়ের দগদগে ক্ষত দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে তখনো মুক্তির অপেক্ষায় থাকা জনগণের অনেকের পেটে ভাতই নেই। এরকম সময়ে সিনেমা? বিশাল চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তাও আবার মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই? সেই সাহসটাই দেখিয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অভিনেতা মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা এবং প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। বিজয় অর্জনের এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নেমে পড়েন ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণের কাজে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরা কালোত্তীর্ণ এই সিনেমার কারণেই চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন একুশে পদকজয়ী এই নির্মাতা চাষী নজরুল ও প্রযোজক মাসুদ পারভেজ। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট। ১৯৭২ সালে ছবিটি নির্মাণে আনুমানিক ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। নিবেদনে ছিল জাগ্রত কথাচিত্র আর পরিবেশনায় স্টার ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটরস। সিনেমা মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই উঠে আসে নির্মাণ ব্যয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আজও কালজয়ী হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’।

 

যেভাবে নামকরণ

ছবিটির নামকরণ প্রসঙ্গে নির্মাতা বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপিত হয়েছিল ১১ দফা ছাত্র আন্দোলন থেকে, যা পরবর্তীকালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। তাছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এই চিন্তা থেকে সবার সম্মতিক্রমে ছবির নাম নির্বাচিত হলো ‘ওরা ১১ জন’।’ নির্মাতার কথায় ছবিটির নামের মতোই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা দৃশ্যে নানা রূপকের ব্যবহার কুশলতার সঙ্গেই ঘটিয়েছেন পরিচালক। সিনেমার শুরুতে ছয়টি কামানের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাতার ভাষ্যে, ওগুলো ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ছয়দফার প্রতীক। ‘ওরা ১১ জন’-এর শুরু সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ দিয়ে। আর শেষ সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দিয়ে। দেশপ্রেম থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের গাথাই যেন গান দুটি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন নির্মাতা।

 

১১ শিল্পী ছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা

এই ছবির ১১ মুক্তিবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই যে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। খসরু, মুরাদ, হেলাল, বেবি, নান্টু, ওলীন, মঞ্জু, আতা, ফিরোজ, আবু, আলতাফ-শেষের জন বাদে এদের কারও ছিল না অভিনয়ের কোনো প্রশিক্ষণ। তারপরও ছবির নব্বই শতাংশেই এঁদের দৃঢ় উপস্থিতি আন্দোলিত করে দর্শকদের। ছবিটিতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অভিনয় সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দীর মূল্যায়ন ছিল এমন, ‘যুদ্ধের সময়কার ‘দুর্জয়-শপথে দৃপ্ত বাংলাদেশ’-এর ছবিই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে এই ১১ জনের মধ্যে। আবেগতাড়িত দর্শক নিজেকেই খুঁজে পায় তাদের মধ্যে। পরিচালকের কৃতিত্ব এখানেই।’

 

ছবিটির নেপথ্যের দুই প্রধান কারিগর সোহেল রানা ও চাষী নজরুল ইসলাম

আসল অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার

এই ছবিতে যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে সত্যিকারের অস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবহার করা হয়। নির্মাতা ছবিটিকে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তোলার আরেকটি প্রয়াস দেখা যায় যুদ্ধকালীন নিউজ ফুটেজ ব্যবহারে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, গণহত্যার ছবি, শরণার্থী শিবিরের দিকে মানুষের ছুটে চলা, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ এবং জনগণের বিজয়োল্লাস- সবকিছুরই একদম প্রথম দিককার এবং বিরল কিছু নিউজরিল কুশলতার সঙ্গে এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে। নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দালিলিক প্রমাণ হিসেবেও তাই সিনেমাটি বিবেচিত হবে সব সময়। সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা। ‘ওরা ১১ জন’-এর পুরোটা জুড়েই পুরুষের পাশাপাশি রণাঙ্গনে নারীর ভূমিকাকে দেখানো হয়েছে সমানভাবে।

 

সেটে অগ্নিশর্মা স্ত্রী

আউটডোরে ছবিটির শুটিং চলছে। প্রযোজক, পরিচালক, রাজ্জাক, শাবানা, নূতনসহ ওরা ১১ জন চরিত্র রূপায়ণকারীরা সবাই শুটিংয়ে ব্যস্ত। এমন সময় ১১ জনের মধ্যে একজনের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী শুটিং স্পটে এসে হাজির। তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে তার স্বামীকে হুকুম দিলেন- যাও গাড়িতে ওঠ তোমাকে আর শুটিং করতে হবে না। সেটের সবাই এমন কান্ডে নির্বাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। কী করবে বুঝে পাচ্ছিলেন না কেউ। সাহস করে এগিয়ে এলেন নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাবি কী হয়েছে?’ রাগ সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘তাকে আর ছবিতে কাজ করতে হবে না। ঘরে নতুন বউ রেখে সে এখানে নায়িকার সঙ্গে প্রেম করছে’। চাষী সাহেব বললেন, ‘না ভাবি এমনটা নয়, কেউ হয়তো আপনাকে শত্রুতা করে মিথ্যা ইনফরমেশন দিয়েছে’। আবার রেগে গিয়ে সেই স্ত্রী বললেন, আমি যা শুনেছি সবই সত্য। ছবিতে তার আর কাজ করার দরকার নেই।’ চাষী সাহেব পড়লেন মহাবিপাকে। অনুনয় বিনয় করে বললেন, দেখুন ভাবি ছবিটির কাজ প্রায় ৭০ ভাগ শেষ। ওকে যদি নিয়ে যান তাহলে ছবিটির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, সে আর প্রেম করতে পারবে না। আমি সব দায়িত্ব নিচ্ছি। ছবির কাজ শেষ হলে আমি তাকে আপনার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আসব, প্লিজ ভাবি ছবিটির স্বার্থে আমার অনুরোধটুকু রাখুন। চাষী ভাইয়ের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে স্বামীর দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। নিজের জীবদ্দশায় শুটিং চলাকালীন সময়ের এমন একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে হেসে কুটি কুটি হয়ে চাষী নজরুল বলেছিলেন, ‘ছবির কাজ শেষ হলে সত্যি আমি তাকে ভাবির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম, ভাবি আপনার স্বামীকে দিয়ে গেলাম, সামলে রাখবেন কিন্তু। চাষী ভাই বলেছিলেন, সিনেমাপ্রেমী ওই মানুষটি আর কখনো ছবিতে অভিনয় করতে না পারলেও কয়েকটি সিনেমা হলের মালিক হয়েছিলেন, মানে সিনেমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেননি তিনি।

 

মাসুদ পারভেজের অনুভূতি

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। যুদ্ধ শেষ করে আমি ও আমার বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলাম এবার কী করব? এর মধ্যেই মাথায় এলো চলচ্চিত্রের কথা। সবাই ভাবলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র। সেই ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রে নাম লিখালাম। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে চাষী নজরুল ইসলামকে দিয়ে নির্মাণ করলাম ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটি। ‘ওরা ১১ জন’ মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র। একে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলা যাবে না। কারণ, এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনের নানা বাঁক, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের নানা কথা উঠে এসেছে। তাই আমি একে অন্য দশটির মতো ছবি বলতে চাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর