বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেল্টম্যান রঞ্জিত মল্লিক এখন

আলাউদ্দীন মাজিদ

বেল্টম্যান রঞ্জিত মল্লিক এখন

‘বেল্টম্যান’ রঞ্জিত মল্লিকের চাবকানো নকল করেছেন ‘জওয়ান’ বিক্রম রাঠোর? শাহরুখের ছবির ভাইরাল এই দৃশ্য নিয়ে মুখ খুললেন প্রবীণ অভিনেতা স্বয়ং। এই ছবিতে একই সঙ্গে বাপ-বেটার চরিত্রে দেখা মিলেছে শাহরুখ খানের। বিক্রম রাঠোর এবং আজাদ, দুই চরিত্রেই সমান সাবলীল বাদশা। বিক্রম রাঠোরের সঙ্গে আজাদের প্রথম সাক্ষাতেই ধুন্ধুমার অ্যাকশন সিকুয়েন্স। ছেলেকে বাঁচাতে মুখে সিগার আর বেল্ট হাতে বিক্রম রাঠোরকে শত্রু নিধন করতে দেখে বাঙালিদের অনেকেই মনে করেছেন রঞ্জিত মল্লিকের কথা। ঠিক রঞ্জিত মল্লিকের মতোই যেন কালীর সাগরেদদের ‘চাবকে পিঠের ছাল’ তুলে দিয়েছে বিক্রম। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে। আমজনতা থেকে চলচ্চিত্রকার, সবাই স্বীকার করেছেন সেই কথা। যেখানে দাবি করা হয়েছে, রঞ্জিত মল্লিকের স্টাইল কপি করেছেন ‘জওয়ান’ শাহরুখ। এ বিষয়ে টলিউডের ‘বেল্টম্যান’ রঞ্জিত মল্লিকের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি হাসিমুখে বলেন, শাহরুখের বেল্টম্যান অবতার নিয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, ‘তবে আমায় ‘বেল্টম্যান’ বানিয়েছে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি। কোমরে চওড়া বেল্ট। সেটা খুলে শাসন করতাম। সঙ্গে দুটো জনপ্রিয় সংলাপ, ‘মেরে চামড়া গুটিয়ে দেব’ আর ‘বাপেরও বাপ থাকে’। ‘শত্রু’সহ একাধিক সিনেমায় কোমর থেকে বেল্ট খুলে গুন্ডাদের চাবকিয়ে লাল করে দিয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক। রেহাই পাননি প্রিয়জনরাও। ‘ছোটবউ’ ছবিতে নিজের ভাই প্রসেনজিৎকে শাস্তি দিতেও কোমর থেকে বেল্ট খুলে চাবকে ছিলেন রঞ্জিত মল্লিক। সে জন্য অনেকেই তাঁকে বাংলা সিনেমার ‘বেল্টম্যান’ বলে থাকেন। টলিউডের তিনি ‘বেল্টম্যান’। না, কথিত কোনো সংলাপ নয়, কবে থেকে যে এই তকমাটা অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের গায়ে লেগে গিয়েছিল তিনি নিজেও জানেন না। ‘চাপকে পিঠের চামড়া তুলে দেব’, এই সংলাপটাই তাঁর থিতু হয়ে যায় একটা সময়ের পর। এক সাক্ষাৎকারে রঞ্জিত মল্লিক জানিয়েছিলেন, বেশ কিছু ছবিতে তিনি নিজের বেল্ট খুলে ভিলেনদের শাস্তি দিয়েছিলেন, সেই থেকেই এই তকমা। জি বাংলার টকশো অপুর সংসারে এসে এ কথাই বলেছিলেন এই অভিনেতা। জানান, তিনি এ বিষয় বেশ শক্ত হাতেই শাস্তি দিতে পছন্দ করেন। ন্যায়ের পক্ষে তাঁর চরিত্র যেভাবে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে এই রূপটাই স্বাভাবিক। তাই বলে অভিনয়ের নামে সত্যি সত্যি মার? অভিনেতা দীপঙ্কর দে একবার এই শো-এর সঞ্চালক শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, তিনি রীতিমতো মার খেয়েছিলেন রঞ্জিত মল্লিকের হাতে। অ্যাকশনের আগে রঞ্জিত মল্লিক নিজেই সবাইকে সাবধান করে দিলেন, দূরে থাকতে বলতেন। সবাইকে সতর্ক করে জানাতেন যাতে কেউ বেশি না এগোয়। কিন্তু পরিচালক অ্যাকশন বললে তিনি নিজেই নাকি ১০ পা এগিয়ে এসে মারতে শুরু করেন। দীপঙ্কর দের এই মজার কাহিনি শুনে সেটে উপস্থিত সবাই হেসে ফেলেন। খোদ রঞ্জিত মল্লিকও বিষয়টা বেশ উপভোগ করেছিলেন। পাশাপাশি স্বীকারও করেছিলেন, যে তাঁর হাতে বহু অভিনেতা তথা ভিলেন চরিত্ররাই মার খেয়েছেন। রঞ্জিত মল্লিকের কথায় এই চরিত্রগুলোই এমন থাকত। তিনি সহজেই গভীরে ঢুকে যেতেন। ফলে এমন অনেক সময়ই হয়ে যেত। রঞ্জিত মল্লিক বিভিন্ন স্বাদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যা দর্শকদের মনে আজো জায়গা করে নিয়েছে। তবে একটা সময়ের পর এমন কিছু চরিত্র তাঁর ঝুলিতে আসে যা থেকে তাঁর চরিত্রের প্রতি দায়িত্ববোধ অনেক বেড়ে যায়। তিনি নিজেই জানান, ‘শত্রু’ ছবিতে ছোট্ট শিশুটি যখন খাবারের অভাবে কাঁদে, তাঁর চোখেও জল চলে আসত। ইতোমধ্যে অভিনয় জীবনের ৫০ বছর পার করে ফেলেছেন রঞ্জিত মল্লিক। মাঝে সাত বছর ক্যামেরা থেকে দূরে ছিলেন। স্বমহিমায় আবার ফিরেছেন। গত বছর ‘ঘোষবাবুর রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান’ দিয়ে অভিনয় জীবনের নতুন ইনিংস শুরু করেছেন। আশি ছুঁই ছুঁই অভিনেতার প্রথম ওয়েব সিরিজ এটি। এরপর অভিনয় করেন ‘তারকার মৃত্যু’ ছবিতে। পরিচালনায় হরনাথ চক্রবর্তী। এখানে তদন্তকারী অফিসার রাজেন মিত্রর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রঞ্জিত মল্লিক।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

১৯৭১ সালে মৃনাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবি দিয়ে তার অভিনয় জীবনের যাত্রা শুরু। প্রথম ছবিতেই তিনি আন্তর্জাতিক সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এরপর তিনি ক্রমশ বাণিজ্যিক ঘরানার ছবিতে নিজের প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। উত্তম কুমারের সঙ্গেসহ নায়কের ভূমিকায় তিনি ‘মৌচাক’ ছবিতে বেশ জনপ্রিয় হন। ধীরে ধীরে দেবী চৌধুরানী, স্বয়ংসিদ্ধা ইত্যাদি ছবিতে তার অভিনয় সবার প্রশংসা পায়। সত্যজিৎ রায় তার ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে মূখ্য চরিত্রে তাকে নির্বাচন করেন। ১৯৭০ সালে প্রধানত নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেও, ১৯৮০-র মাঝভাগ থেকে তিনি ক্রমশ বড় ভাই, মামা বা সমাজের আদর্শ পুরুষ ইত্যাদি চরিত্র যা কিনা সরাসরি নায়কও নয় আবার নায়কের থেকে কমও নয়- এরকম চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। গুরুদক্ষিণা, ছোটবউ, সংঘর্ষ ইত্যাদি ছবি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উত্তম পরবর্তী যখন বাংলা ছবির দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল সেই সময় ১৯৮৪ সালে পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি ‘শত্রু’ সিনেমায় এক সৎ নির্ভিক পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবি বাংলা ছবিতে একটি মাইলস্টোন হয়ে আছে।

এক সময় অঞ্জন চৌধুরীর প্রত্যেকটি ছবিতে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন রঞ্জিত মল্লিক। সেই সময় রঞ্জিত মল্লিক থাকা মানেই ছিল ছবি সুপারহিট। অপরদিকে, হরনাথ চক্রবর্তী কেরিয়ার শুরু করেছিলেন অঞ্জন চৌধুরীর সহকারী হিসেবে। তাই কেরিয়ারের শুরু থেকেই রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে কাজ করেছেন হরনাথ। পরবর্তী সময় হরনাথের একের পর এক ছবিতে কাজ করেছেন রঞ্জিত মল্লিক। এই জুটির সুপারহিট ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম নবাব, মঙ্গলদীপ, শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ, দাদা ঠাকুর, সাথী, নাটেরগুরু, নবাব নন্দিনী, আশ্রয় প্রভৃতি।

 

বঙ্গবিভূষণ এবং শেরিফ

শুধু একজন অভিনেতাই নন তিনি। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তাকে কলকাতার শেরিফ নির্বাচন করেন। ২০১২ সালে সম্মানজনক বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন।

 

রঞ্জিত মল্লিকের জনপ্রিয় যত ছবি

শত্রু, গুরুদক্ষিণা, ছোটবউ, বন্দিনী, আক্রোশ, নবাব, শাখা প্রশাখা, তুমি যে আমার, মুখ্যমন্ত্রী, সুন্দর বউ, সাথী, জজ সাহেব, চৌধুরী পরিবার, সংঘর্ষ, নাটের গুরু, মঙ্গলদীপ প্রভৃতি।

এখনো সমান জনপ্রিয়

পর্দা থেকে এখন প্রায় দূরে থাকলেও জনপ্রিয়তা কিন্তু একটুও কমেনি টলিউড অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের। বরং দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। একটা সময় পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেও বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। আর সে কারণেই আজো দর্শকের মন থেকে মুছে যাননি। অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর জীবনে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। বাবার দেখানো পথ অনুসরণ করেছেন মেয়ে কোয়েল মল্লিক। তিনিও বেশ জনপ্রিয় টলিউড পাড়ায়।

সর্বশেষ খবর