বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এক অন্তবিহীন স্বপ্নের শিল্পী মাহমুদুন্নবী

এক অন্তবিহীন স্বপ্নের শিল্পী মাহমুদুন্নবী

বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তি শিল্পী মাহমুদুন্নবী। অনুকরণীয় কণ্ঠশৈলীতে চমৎকার সব গান গেয়ে ষাটের দশকে আধুনিক বাংলা গানে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কেবল গানই লালন করেছেন তাঁর হৃদয়ে। এ যুগেও তাঁর গানের আবেদন অমলিন। তাঁর সুযোগ্য চার সন্তান বাবার পথেই হাঁটছেন। গতকাল ছিল মাহমুদুন্নবীকে হারানোর ৩৩ বছর। এ কিংবদন্তি শিল্পী ও তাঁর সংগীত পরিবারকে নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

বেদনা ও প্রেমের শিল্পী

১৯৩৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানের কেতু নামক অজপাড়াগাঁয় মাহমুদুন্নবীর জন্ম। দেশ বিভাগের পর সপরিবারে তাঁরা তদানীন্তন পূর্ববাংলায় চলে আসেন এবং খুলনায় স্থায়ী হন। তবে বাবার কর্মক্ষেত্র ফরিদপুরেই কেটেছে মাহমুদুন্নবীর শৈশব ও কৈশোর। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে কিছুকাল চট্টগ্রামে, পরে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর চেতনা আর শিল্পীসত্তা চালিত হয়েছিল সুরের টানে। ঢাকার ইসলামপুরে একজন ওস্তাদের কাছে কিছুকাল গানের তালিম নেন মাহমুদুন্নবী।

 

গানের ভুবনে উজ্জ্বল অনুপ্রবেশ

১৯৫৫ সালে এসএসসি পাস করার পরপরই সুরের টানে বাড়ি থেকে পালিয়ে করাচি যান তিনি। শেখ লুৎফর রহমান, নিজাম উল হকদের সঙ্গে এক মেসে থাকতেন। সেখানে মাঝেমধ্যে যেতেন মেহেদী হাসান। মাহমুদুন্নবীর গান শুনে সংগীতের বরপুত্র মেহেদী হাসান বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যদি তোমার মতো কণ্ঠ মাধুর্য আমাকে দিতেন তাহলে আমি বিশ্বজয় করতাম।’ এরপর করাচি বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রচারিত হয় তাঁর প্রথম গান ‘পথে যেতে দেখি আমি যারে’। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা এ গানটির মাধ্যমেই আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে উজ্জ্বল অনুপ্রবেশ শিল্পী মাহমুদুন্নবীর। করাচিতে আঁধুরী দস্তা নামের এক ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। এর অব্যবহিত পর শিল্পীর আটটি গান নিয়ে আধুনিক গানের একটি লং প্লে রেকর্ড প্রকাশ হয়। দেশে ফিরে ১৯৬২ সালে ঢাকা রেডিওর অডিশনে পাস করেন। ১৯৬৬ সালে কাগজের নৌকা ছবিতে ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে ‘দেখে কেন মনে হয় যেন তারে চিনি’ এবং ১৯৬৭ সালে চাওয়া-পাওয়া ছবিতে আরেকটি রোমান্টিক গান ‘কিছু আগে হলে ক্ষতি কি ছিল দেখা হলোই যখন’ করেন। ষাটের দশকের শুরুতে মাহমুদুন্নবী ঢাকায় স্থায়ী হন। এ সময় থেকে ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। শিল্পের প্রতি যেমন, তেমনি সমাজের প্রতিও দায়বদ্ধ ছিলেন শিল্পী মাহমুদুন্নবী। ষাটের দশকে পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ছিল তাঁর সম্পৃক্ততা। এ সময় তাঁর গাওয়া গণজাগরণমূলক বেশকিছু গান মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে।

 

একজন ভারসেটাইল জিনিয়াস

মাহমুদুন্নবী ছিলেন একজন ভারসেটাইল জিনিয়াস। যদিও অধিকাংশ সংগীতবোদ্ধা তাঁকে একটা জেনুইন প্যাথেটিক ভয়েস বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রোমান্টিক, প্যাথেটিক যাই হোক না কেন মাহমুদুন্নবীর শিল্পীসত্তার মূল বৈশিষ্ট হলো- তাঁর কণ্ঠের অপরিমেয় গভীরতার সহজাত আবেগ। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় গায়িকা নির্মলা মিশ্র বলেন, ‘মাহমুদুন্নবীদা’র কণ্ঠে বিধাতা এত আবেগ দিয়েছেন! ১৯৬৮ সালে ঢাকা মেইড উর্দু ছবি ‘পায়েল’-এ মাহমুদুন্নবীর গাওয়া ‘হাওয়া ধীরে বহে না, ঘাটা ধীরে চালনা’ শ্রোতাদের বিস্ময়াভিভূত করেছিল।

 

প্রথম গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি

মাহমুদুন্নবী ১৯৭৫ সালে ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে’ গানটির জন্য বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তিত হলে তিনি ‘দি রেইন’ ছবিতে ‘আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই’ গানটির জন্য প্রথম গায়ক হিসেবে ১৯৭৭ সালে জাতীয় পুরস্কার জিতে নেন। শিল্পীর দুর্ভাগ্য হারজিৎ ছবিতে তাঁর একটি মাস্টারপিস ‘সুরের ভুবনে আমি আজো পথচারী’ গানটিও তিনি একই বছর গেয়েছিলেন। না হলে এ গানটিরও পুরস্কার জেতার কথা ছিল। স্বরলিপি ছবিতে তাঁর একটি সিনসিয়ার পরিবেশনা ছিল ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। অসাধারণ গানের জন্য তাঁর নাম এখনো উপমহাদেশের সুপরিচিত ইমোশনাল শিল্পী জগন্ময় মিত্র, সতীনাথ মুখার্জির সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

 

স্মরণীয় রোমান্টিক যেসব গান

শিল্পী হিসেবে মাহমুদুন্নবীর বড় কৃতিত্ব ৩০ বছরের সংগীত জীবনে তিনি কখনো নিম্ন রুচির গান করেননি। গুটিকয়েক চটুল প্রেমের গান গেয়েছেন, তাও তাঁর একনিষ্ঠ গায়কিতে উঠে গিয়েছিল শিল্পের মাত্রায়। অনেক হৃদয়গ্রাহী গান উপহার দিয়েছেন শিল্পী মাহমুদুন্নবী। সেসব গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘চঞ্চল এক গানের পাখি’, ‘প্রেমের নাম বাসনা’, ‘আমি যে কেবল বলেই চলি’, ‘কি আনন্দ দিয়ে এ ভুবন মাতিয়ে’, ‘ওই মধু চাঁদ আর এই জোছনা’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘এক অন্তবিহীন স্বপ্ন ছিল’, ‘নেই অভিযোগ কারো কাছে’, ‘সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম’, ‘কে আমায় আলোর ঠিকানা বলে দেবে’, ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ আমার অজান্তে’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘মন তো জানে না মন চায় কি’, ‘এ জীবন যেন এক ছন্দ’, ‘আয়নাতে ওই মুখ’, ‘ও মেয়ের নাম দেব কী’, ‘দু’চোখ আমার এ কোন আলোয়’ সহ অসংখ্য গান।

 

গানপাগল অভিমানী

মাহমুদুন্নবী ছিলেন সহজ-সরল, মিষ্টভাষী এবং গানপাগল অভিমানী এক মানুষ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কেবল গানই লালন করেছেন তাঁর হৃদয়ে। সংগীতাঙ্গনে বিস্তৃত অবদান রাখা সত্ত্বেও মাহমুদুন্নবীর মতো শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। তাঁর নামে একুশে পদক ঘোষণা করেও প্রদান করা হয়নি। ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর অনেক অভিমান নিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমান।

 

কিংবদন্তি শিল্পী মাহমুদুন্নবীর সুযোগ্য চার সন্তান তানজিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী এবং রিদওয়ান নবী পঞ্চম (বাঁ থেকে)

বাবাকে নিয়ে আবেগঘন ফাহমিদা নবী

ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী- দুই বোনই সংগীতাঙ্গনে সমান জনপ্রিয়। দুজনে বেড়ে উঠেছেন প্রায় একসঙ্গে। তাদের মতে, দুজনেই গান করেন প্রাণের আনন্দে। এদিকে গতকাল বাবা মাহমুদুন্নবীর ৩৩ বছর প্রয়াণে স্মরণ করে ফাহমিদা বলেন, ‘আজ আমার বাবার চলে যাওয়ার দিন। ২০ ডিসেম্বর ১৯৯০ সাল। ৩৩ বছর হয়ে গেল! কত স্বপ্ন পেছনে ফেলে সময় যখন তখনই চলে গেল। সব তো পূরণ হয় না, কিছু অপূর্ণতা রেখেই চলে যেতে হয়। আব্বা আমার আয়না। আমি আমাকে দেখি সেই আয়নায়। আমার পরিবার, আমার ভাইবোন, আম্মা, আমাদের সন্তানরা এবং আমার বাবার শ্রোতারা প্রত্যেকে আমার আয়নার অংশ। যে আয়নার আলোকে পথচলার সাহস এক ধরনের ধৈর্য তৈরি করেছে। সেই ধৈর্য-সহ্যের মধ্যে আছে চোখে দেখার নেবার ধারণ ক্ষমতা। শুদ্ধতা যেখানে বিলীন, সেখানে কীসের সঙ্গে আপস? সংগীতের সঙ্গে রুচিশীলতার যে সম্পর্ক তা তো আসলে স্নিগ্ধতা, সুদূরপ্রসারী সুরের মোহ থাকে। তা নিয়ে তো ভাবনা নেই বর্তমানে! তাই তো সাহসী একটা আয়না আমাকে প্রতিনিয়ত বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতি দেয়, গান হচ্ছে শোনার আর অনুভবের, দৌড়াবার বা পিছিয়ে পড়বার নয়। হারানোর কিছু নয়। বাবা হিসেবে শুধু নয়, একজন প্রিয় জনশ্রুত শিল্পী মাহমুদুন্নবী যুগে যুগে তাই একবারই আসে, যাকে ভালোবাসে মানুষ তাঁর সুরের অলংকরণের আর বিনয়ের কারণে। আজও প্রাণে ধারণ করে বলে- কত ভালো মানুষ ছিলেন, কত বড় বিনয়ী শিল্পী ছিলেন! তাঁর মতো সুরের রাজা আজও আর দেখলাম না! আমার কথা নয় শ্রোতার কথা। তখন তো গান দেখার বিষয় ছিল না! আমিও মনে করি গান শোনার, ছিল, আছে, থাকবে! তাই আয়নার গভীরে কোনো প্রতিযোগিতার দৌড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আমি সেই আয়নার প্রতিবিম্বে দাঁড়িয়ে, আমার গানের প্রান্তে আজকের শিল্পচর্চার দেয়াল দেখি আর ভাবি আজ একজন মাহমুদুন্নবী হয়ে ওঠার জন্য শিল্পী নেই আছে তারকার ভিড়! তাই তো সেই কণ্ঠ এখনো নবীন এখনো তারার মতো জ্বলজ্বলে এক আলোকবর্তিকা। শ্রোতার ভালোবাসা ও সম্মান পাওয়া বিশাল অর্জন। ধন্যবাদ শ্রোতাদের যাদের জন্য আব্বা অমর হয়ে আছেন মানুষের মনে, শ্রোতার জাগরণে। আব্বার আত্মার জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন তাঁর সেই সম্মানকে ধরে রাখতে পারি।

 

মাহমুদুন্নবীর সুযোগ্য চার সন্তান

রাশিদা চৌধুরী প্রয়াত শিল্পী মাহমুদুন্নবীর সহধর্মিণী। তাদের সুযোগ্য চার সন্তান-ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, রিদওয়ান নবী পঞ্চম ও তানজিদা নবী। এ চারজনই গানে-কথায় শিল্পী মাহমুদুন্নবীকে সর্বদা স্মরণ করেন। বড় বোন ফাহমিদা পৌনে তিন বছরের বড় সামিনার থেকে। এদিকে তাঁদের ছোট বোন তানজিদা নবী থাকেন লন্ডনে। একমাত্র ভাই রিদওয়ান নবী চৌধুরী পঞ্চম, যাকে সবাই ‘আর্কের পঞ্চম’ নামে চেনে। তিনি ঢাকায় ব্যস্ত গান নিয়ে। বাবাকে নিয়ে ফাউন্ডেশন করার পরিকল্পনা তাঁদের অনেক দিনের স্বপ্ন। বাবার গান সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা। বিভিন্ন শো, রেডিও, টেলিভিশনে নিয়মিত গাইছেন বাবার গান। বাবাকে নিয়ে তৈরি করছেন অসংখ্য গান।

 

তাদের আস্থা বাবা

বাবাকে নিয়ে সামিনা নতুন কিছু গান করছেন। বাবাকে নিয়ে আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। বাবার স্মৃতিকে মনে করে অতীত স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন বারবার তিনি। ফাহমিদা নবীর গাওয়া গানে রচিত হয়েছে জীবনের অগণিত গল্প! তাঁর সেই গানের শুরুটা কিন্তু নিজের ঘর থেকেই। বাবাকে নিয়ে স্মৃতির ডালি টেনে তিনি বলেন, ‘যাঁর ওপর ডানা মেলে কাজ করে যাচ্ছি, তিনি তো আমার বাবা মাহমুদুন্নবী! অনেক ঝড় যায়, ভয় পাই না। কারণ ইচ্ছা, চাওয়া এবং গভীর অভিমানের ভালোবাসাকে এক করে, কণ্ঠকে শুধু ভালো গানের জন্যই লালন করে যাচ্ছি। যার মূল্য কে দেবে, কে দেবে না-ভাবার সময় নেই! আছে শুধু ছায়ার মতো নির্ভরতার আস্থা আর সত্যের এক ভিত। মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি বাবার মতো। তাঁর গানের ঝুলিতে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো গানই নেই! যা আছে সব প্রিয় তাঁর খাতায়।’

সর্বশেষ খবর