বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

কান্নাকাটি করা মায়ের ভূমিকা আর চাই না : ববিতা

আলাউদ্দীন মাজিদ

কান্নাকাটি করা মায়ের ভূমিকা আর চাই না : ববিতা

“তখনো সকালের প্রার্থনায় মগ্ন আমি। দূর থেকে সকালে পাখির ডাক কানে বেজে উঠল, শেফালি ফুলের সুগন্ধিটা আজ অন্যরকম মাদকতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। ভোরের সূর্যের আভাটাও বেশ ঝলমলে। চোখেমুখে সবকিছু কেমন জানি অন্যরকম ঠেকছে। কিন্তু কেন? আমি যখন এ নিয়ে ভাবনার অতলে ডুব দিয়েছি তখনই কে যেন ইশারায় শিস দিয়ে বলে উঠল ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২৪’। ওয়াও, তাইতো, নতুনের আগমনে মনটা আনন্দ আবেগে ভরে  গেল। এক নিমেষে সবাইকে জানিয়ে দিলাম আজকের নতুন ভোরের ভালোবাসার বার্তা।”- নতুন বছরের আগমনের এমন হৃদয়কাড়া ভূমিকাটা একজনই দিতে পারেন। তিনি হলেন আমাদের চলচ্চিত্রের লিজেন্ড আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা। এ অভিনেত্রী নতুন বছরে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বছরগুলো এভাবেই  চলে যাবে, কিন্তু কাজ সবাইকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাই কাজের মাঝেই আমাদের বাঁচতে হবে।’

 

নতুন বছরে যত প্রত্যাশা

ববিতা বলেন, নতুন বছরের প্রত্যাশার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা আমাদের জীবন থেকে প্রতিদিন একেকটা করে দিন হারিয়ে ফেলছি, মানে জীবনের শেষ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ফেলে আসা দিনগুলোতো আর ফিরে আসবে না। তাই অতীতকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বর্তমানের সমৃদ্ধ কাজের মাধ্যমে। কল্যাণকর কাজ দিয়ে আগামীকে কীভাবে আরও উন্নতর করব, কাজের মাঝে দেশ, জাতি ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব সেই চেষ্টাই করে যেতে হবে। নতুন বছরে আমি একটি নিয়মতান্ত্রিক দেশ চাই, এ নিয়ম হতে পারে পথে, মাঠে, ঘাটে, হাটে এবং প্রাসাদ থেকে কুঁড়েঘর, সর্বত্রই।

 

চলচ্চিত্র ঘিরে যে স্বপ্ন

ববিতা বলেন,  আমাদের চলচ্চিত্রের একটি সোনালি অতীত ছিল, দেশ-বিদেশে আমাদের চলচ্চিত্রের প্রশংসা ছিল। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একটি স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিয়েছিল। একটা সময় আমাদের দেশে আবদুল জব্বার, নাজির আহমেদ, জহির রায়হান, আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান, নারায়ণ ঘোষ মিতাসহ অসংখ্য শিক্ষিত, দক্ষ ও গুণী নির্মাতা ছিলেন। একই সঙ্গে বলিষ্ঠ অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলীও ছিলেন। যাদের হাত ধরে আমাদের চলচ্চিত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে একদিকে গুণীদের পৃথিবী কিংবা চলচ্চিত্রজগৎ থেকে বিদায়, অন্যদিকে নানা নেতিবাচক কারণে ঢাকার চলচ্চিত্র কৌলীন্য হারাতে শুরু করে। এ অবস্থার উত্তরণ আজ পর্যন্ত শতভাগ সম্ভব হয়নি। জীবনধর্মী গল্প নেই, যথেষ্ট পরিমাণে গুণী নির্মাতা নেই, দক্ষ অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীর অভাবও কাটছে না। কিছু ছেলেমেয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করে নির্মাণে আসছে ঠিকই; কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। অন্যদিকে তাদের ছবি আগের মতো সারা দেশের সিনেমা হলে চলছে না, কয়েকটি সিনেপ্লেক্স এবং ঢাকার হাতেগোনা কয়টি সিনেমা হলেই শুধু প্রদর্শিত হচ্ছে। এতে সেই ছবি তো আপামর দর্শকের কাছে পৌঁছায় না। অথচ একসময় আমাদের ছবি সারা দেশের সিনেমা হলেই চলত। দর্শক সপরিবারে সিনেমা হলে আসত। যা এখন অকল্পনীয়। এ অবস্থায় আমাদের আগামী চলচ্চিত্রকে ঘিরে কেমন স্বপ্ন দেখব তা আমি জানি না।

 

মা হয়ে শুধু কাঁদতে চাই না

দেখুন, আমিতো চলচ্চিত্রের একজন মানুষ। আমার রক্ত, অস্থিমজ্জায় চলচ্চিত্র মিশে আছে। আমারও খুব মন চায় চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসি। অভিনয়ের প্রচুর প্রস্তাবও আসছে। কিন্তু আমাদের মতো শিল্পীদের অভিনয় করার মতো ছবি কোথায়? জীবনধর্মী গল্প নিয়ে এখন কি আর তেমনভাবে ছবি নির্মাণ হচ্ছে? মনে করুন আমাকে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। সেই ছবিতে নায়িকার সংক্ষিপ্ত পোশাক, আইটেম গানের নামে অশ্লীলতা, আরও মানহীন যা থাকার সবই থাকছে, সেখানে আমার রূপায়িত মায়ের চরিত্রটি শুধু আবেগ আর কান্নাকাািটর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এমন চরিত্রে আর কত অভিনয় করব। সিনিয়র শিল্পীদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাস্ট করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ছবি নির্মাণ হয়। এখানে কেন নেই। এ ধরনের ছবি যদি কেউ নির্মাণ করে তাহলেই শুধু অভিনয়ে ফিরব।

 

বিদেশে এখনো সম্মান পাই

আমাদের দেশের সোনালি দিনের অভিনয়শিল্পীরা এখনো বিদেশের মাটিতে সম্মানিত হয়। এই যেমন গত বছরের ৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস অঙ্গরাজ্যে আমাকে নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘ডালাস বাংলা চলচ্চিত্র উৎসব।’ এতে আমাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে প্রতিবছরের ৫ আগস্টকে সেদেশে ‘ববিতা ডে’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন ডালাসের মেয়র রিচার্ডসন। এ সম্মান আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের। কারণ আজ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বা অন্য কোনো দেশের চলচ্চিত্রের মানুষকে ঘিরে এমন সম্মানের আয়োজন কখনো হয়নি। এর আগে ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘ডিসিআইআই’ আমাকে শুভেচ্ছা দূতের সম্মান দেয়। এছাড়া তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবসহ চলচ্চিত্রকে ঘিরে বিশ্বের অনেক দেশের এমন আয়োজনে বাংলাদেশি অভিনেত্রী হিসেবে আমাকে সম্মানিত করা হয়। আমি চাই এখনকার নির্মাতা এবং শিল্পীরাও যেন এমনভাবে বিদেশের মাটি থেকে দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়বোধ থাকতে হবে। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা বলেন, চলচ্চিত্রসহ দেশের সব সেক্টরের প্রতি সবাইকে দায়িত্ববান হতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অতি সহজেই গড়ে তোলা যাবে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রও সংশ্লিষ্টকে সম্মানিত করবে। যেমন আয়কর দেওয়া নাগরিকদের কর্তব্য। আমি নিয়মিত এ কর পরিশোধ করি বলে গত বছর রাষ্ট্র আমাকে সেরা করদাতার পুরস্কারে ভূষিত করেছে। আরেকটা বিষয় হলো সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রতিবছর যে অনুদান দেয় তার যথাযথ ব্যবহার ও নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে বলব দেশকে এগিয়ে নিতে জনগণকে দায়িত্ববান হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বছরটি সবার জন্য সুন্দর হোক, মঙ্গল বয়ে আনুক নতুন বছরে এ আমার কামনা।

সর্বশেষ খবর