বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

হারিয়ে গেছে সিনেমার অভিনব প্রচারণা

আলাউদ্দীন মাজিদ

হারিয়ে গেছে সিনেমার অভিনব প্রচারণা

রিকশা বা ঘোড়ার টমটম গাড়িতে মাইক ব্যবহার করে ‘হ্যাঁ ভাই আসিতেছে...’। এমন হাঁক ছেড়ে নতুন সিনেমার প্রচার বছরের পর বছরজুড়ে কত হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই।  এই প্রচারে প্রেক্ষাগৃহের মালিকরাও থাকতেন উজ্জীবিত...

 

‘হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে আসিতেছে আগামী শুক্রবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে...’। সিনেমার বিজ্ঞাপনের এমন দরাজ কণ্ঠের ঘোষণা সেই সত্তর থেকে নব্বই দশক সময়ের দর্শকদের কানে এখনো বাজে। কিন্তু এখন সেই প্রচারের এমন দরাজ কণ্ঠ যেমন নেই তেমনি নেই অভিনব যত প্রচারণা। তাই দর্শকও আর সিনেমা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না কোনো প্রেক্ষাগৃহে। শুধু রেডিওতে নয়, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, ব্যান্ড পার্টি, ট্রাক, বিশাল ফেস্টুন, পোস্টার এমন কতকিছুই ছিল সে সময়ের সিনেমার প্রচারের জন্য। আজ যা অতীত।

 

‘কণ্ঠরাজ’ নাজমুল হোসাইন ও মাজহারুলের জাদুকরী কণ্ঠ...

সেই সময়ে সিনেমার বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিয়ে নাজমুল হোসাইন এবং মাজহারুল ইসলাম নামের দুজন কণ্ঠদাতা রীতিমতো তারকা খ্যাতিই অর্জন করে ফেলেছিলেন। নাজমুল হোসাইনকে তার জাদুকরী কণ্ঠের জন্য ‘কণ্ঠরাজ’ উপাধিও দেওয়া হয়েছিল। চলচ্চিত্রে যার পরিচয় সহকারী পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, বিজ্ঞাপন কণ্ঠদাতা হিসেবে।

 

সেই সময়ের প্রচারণার যত ধরন...

আগে প্রযুক্তির যেসব সুবিধা ছিল সেগুলো আজকের মতো এত ব্যাপক ও সুবিস্তৃত না থাকলেও সেই সীমিত প্রযুক্তির মাধ্যমেই যতটুকু পারা যায়, ততটুকু সুবিধা নিয়েই বাংলা সিনেমাকে দেশের আপামর সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ সিনেমা প্রচারের জন্য প্রযুক্তির সেই সুবিধাগুলোও যথেষ্ট কার্যকর ছিল। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান রেডিও। তখন টিভি প্রতি ঘরে ঘরে না থাকলেও রেডিওর ব্যবহার মোটামুটি অনেকেরই হাতে হাতে ছিল। কমপক্ষে ওয়ানব্যান্ড রেডিও তো শ্রমজীবী অনেক মানুষের হাতে-হাতেই থাকত। কখনো বা তাতে দুই বা ততধিক শ্রোতাও থাকত। সেই রেডিওর প্রধান আকর্ষণই ছিল নতুন মুক্তি আসন্ন সিনেমার প্রচারণা। বাংলা সিনেমার প্রচারে রেডিও বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সত্তর থেকে প্রায় নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বেলা ১টার পর থেকেই শুরু হতো মুক্তিপ্রাপ্ত অথবা মুক্তি প্রতীক্ষিত ছায়াছবির ওপর ভিত্তি করে বিশেষ অনুষ্ঠান। পরপর দুই-তিনটি সিনেমার বিজ্ঞাপন অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। প্রতিটি সিনেমার বিজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের দৈর্ঘ্য ছিল ১৫ মিনিট। এ ১৫ মিনিট দেশের আপামর শ্রোতা রেডিওর পাশে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকত মুক্তিপ্রাপ্ত বা মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতে। আর তাতেই ভেসে উঠত নাজমুল হোসাইন এবং মাজহারুল ইসলামের সেই জাদুকরী কণ্ঠ-‘হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে...’।

 

রিকশা ও টমটম গাড়িতে মাইক...

সিনেমা প্রচারণায় আরও একটি ব্যবহারও দেখা গেছে ব্যাপক। সেটি হচ্ছে মাইক। রিকশা বা ঘোড়ার টমটম গাড়িতে মাইক ব্যবহার করে ‘হ্যাঁ ভাই আসিতেছে...’। এমন হাঁক ছেড়ে নতুন সিনেমার প্রচার বছরের পর বছরজুড়ে কত হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। এ প্রচারে প্রেক্ষাগৃহের মালিকরাও প্রতি সপ্তাহে থাকতেন উজ্জীবিত। প্রেক্ষাগৃহের সামনে সহ দর্শকের নজরে পড়ে এমন সুবিধামতো স্থানে নায়ক-নায়িকার চিত্রসহ সিনেমাটির গল্পের মূল ভাব নিয়ে যে একাধিক বিশাল রঙিন ব্যানার ফেস্টুন টাঙিয়ে রাখতে দেখা যেত সেটাও এখন কোনো প্রেক্ষাগৃহে দেখা যায় না। বিলুপ্তই হয়ে গেছে সেই বাহারি চিত্রটি। তাই ঢাকাই সিনেমার সঙ্গে একসময়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের যেরকম আত্মীয়তা বা সম্পৃক্ততা ছিল সেটা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এখনো মাঝেমধ্যে সিনেমার প্রচারণায় অভিনবত্ব দেখা যায়। যেমন ২০২২ সালের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ভৌতিক গল্পের ‘জ্বীন’ সিনেমার প্রচারে এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে, ‘জ্বীন সিনেমা একা দেখতে পারলেই- এক লক্ষ টাকা পুরস্কার।’ বি: দ্র:- ১. ভয়ের কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জাজ মাল্টিমিডিয়া বা হল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। ২. হলের বাহিরে একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকবে ৩. যদি সম্পূর্ণ সিনেমা না দেখতে পারেন তাহলে আপনাকে হলের ভাড়া ও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিতে হবে। ৪. যদি সম্পূর্ণ সিনেমা দেখতে পারেন, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না, জাজ মাল্টিমিডিয়া আপনাকে নগদ ১ লক্ষ টাকা দেবে এবং কোক নাস্তা খাওয়াবে বা দিয়ে দিবে।’ ওই ঈদে মুক্তি পেতে যাওয়া আরেকটি ছবি অনন্ত-বর্ষা অভিনীত ‘কিল হিম’ ছবির প্রচার চালানো হয় এভাবে- ‘এই ছবিতে সবাই ভিলেন’ ছবির নায়ক অনন্ত জলিল বলছেন, ‘ছবির নায়িকা বর্ষা আমাকে ভিলেন বানিয়েছে, কীভাবে সে আমাকে ভিলেন বানালো তা দেখতে বড় পর্দায় চোখ রাখতে হবে।’ আবার নায়ক অনন্ত পুলিশের পোশাক পরা একটি ছবি পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করে দর্শকের কাছে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘ভিলেন অনন্ত’র গায়ে পুলিশের পোশাক কেন? তা দেখতে ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করুন আপনারা।’ আসলে এসবই হচ্ছে ছবির সাফল্য বয়ে আনতে অভিনব প্রচারণা বা কৌশল। ঢাকাই ছবিতে এর আগে বহুবার এমন অভিনব প্রচার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন নির্মাতারা, এমন কথা জানিয়ে সিনিয়র চলচ্চিত্র প্রযোজক ও প্রদর্শক মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ‘১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া মমতাজ আলী পরিচালিত ও নায়ক উজ্জল প্রযোজিত ও অভিনীত ‘নসীব’ ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়- ‘৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ল্যাবে পরিস্ফুটিত ছবি হলো নসীব।’ তৎকালে এমন বিগ বাজেটের ছবির কথা শুনে দর্শক ছবিটি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ছবিটি সুপারহিট। মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, আসলে এটি ৩ কোটি টাকার ছবি ছিল না। ৩ কোটি মানে তখন অনেক টাকা। তখন একটি সমৃদ্ধ রঙিন ছবি নির্মাণ করতে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হতো না। এ সিনিয়র চলচ্চিত্রকার মজা করে বলেন, কথায় আছে না  ‘সিনেমার গরু গাছে চড়ে’,  একটি সিনেমায় গরু গাছে চড়ছে এমন ভুয়া প্রচার চালানোর ফলে ষাট দশকের সহজ সরল দর্শকরা সিনেমা হলে ছবিটিতে গরু কীভাবে গাছে চড়ে তা দেখতে ভিড় করে, কিন্তু  ছ্িবটির কোথাও গরুকে গাছে চড়তে দেখা যায়নি। ফলে দর্শকরা অসুন্তুষ্ট হয় এবং তখন থেকেই এমন অভিনব প্রচারণার অবতারণা হলেই সবাই বলে ‘এটি অসম্ভব কিছু নয়, কথায় আছে না সিনেমার গরু গাছে চড়ে!’ এ নির্মাতা আরও জানান, ১৯৬৭ সালে ‘শহীদ তিতুমীর’ ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবির প্রতি দর্শক নজর কাড়তে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রচার চালায় এই বলে যে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলে দর্শকরা চাইলেই তা নেভাতে পারবেন। এমন কথা শুনে অনেক দর্শক বালতিভর্তি দুধ নিয়ে সিনেমা হলে যায় এবং ছবিতে বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলেই সিনেমা হলের পর্দায় দর্শকরা দুধ ঢেলে দিত। মিয়া আলাউদ্দীন আরও জানান, আগে একটি ছবি সফল করতে শুধু অভিনব প্রচারণাই চালানো হতো না, আশ্রয় নেওয়া হতো নানা কৌশলের। যেমন, যে ছবিটির প্রথম টিকিট কাটবে সে পাবে আকর্ষণীয় পুরস্কার অথবা ছবিটির বিক্রিত টিকিট লটারিতে তোলা হতো। এতে পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী পেতেন টিভি, ফ্রিজ, রেডিও বা আরও অনেক মনকাড়া পুরস্কার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকার রিটার্ন টিকিটেরও ব্যবস্থা থাকত। টিকিটের সঙ্গে আকর্ষণীয় উপহারও দেওয়া হতো। বর্ণিল প্রচার চালানো হতো ছবির পোস্টার-ব্যানারখঁচিত ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, ট্রাকের সারি, ব্যান্ড পার্টি নিয়ে সারা শহর গ্রাম প্রদক্ষিণ করা, ছবির ব্যানার পোস্টারে সজ্জিত অজস্র ট্রাকের সারি নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া, সিনেমা হলকে রঙিন বাতি আর ব্যানার দিয়ে সাজানো, মাইক, রেডিও, টিভি ও পত্রিকায় আকর্ষণীয় প্রচার চালানো ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালে প্রখ্যাত নির্মাতা আজিজুর রহমান তার ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিটি মুক্তি দেওয়ার আগে কয়েক মাস ধরে দর্শকদের জন্য ছবিটি নিয়ে পত্রিকায় কুইজের আয়োজন করেন। বিজয়ীরা লাভ করেন এ ছবির গানের লং প্লে।

 ১৯৬৭ সালে ‘শহীদ তিতুমীর’ ছবিটি মুক্তি পায়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রচার চালায়,  তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলে দর্শকরা চাইলেই তা নেভাতে পারবেন। এমন কথা শুনে অনেক দর্শক বালতিভর্তি দুধ নিয়ে সিনেমা হলে যায়...

 

পত্রিকার বিজ্ঞাপনেও অভিনবত্ব

‘কাপুরুষ কি কখনো মহাপুরুষ হতে পেরেছিল? উত্তরের অপেক্ষায় থাকুন’। আশির দশকের ছবি ‘কাপুরুষ’-এর পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন ছিল এটি। এমনই নানা ট্যাগ লাইন, স্লোগান ও বক্তব্যে ভরপুর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো পত্র-পত্রিকায়। থাকত নানা কুইজও। ‘জ্বিনের বাদশা’ ছবির বিজ্ঞাপনে কয়েকটি ছবি দিয়ে বলা হয়েছিল- এদের মাঝ থেকে বাপ্পারাজকে খুঁজে বের করুন।

 

সিনেমার ব্যানার আঁকিয়ে সেই শোয়েব

কামরাঙ্গীরচরের শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েব। বয়স এখন প্রায় ৬৮ বছর। তিন দশকের বেশি সময় ধরে উজ্জ্বল রঙে দোর্দণ্ড প্রতাপে তিনি সিনেমার ব্যানার এঁকেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। রাজ্জাক, ইলিয়াস কাঞ্চন, জসিমের মতো বিখ্যাত নায়কেরা তাঁকে সসম্মানে ডাকতেন নিজেদের সিনেমার ব্যানার আঁকতে। তার কথায় অবুঝ মন, জিঘাংসা, জোকার, বেদের মেয়ে জোছনা সব ফিলিমের ব্যানার আঁকলাম। কত ফিলিম হিট হইলো। মুন, স্টার, লায়ন-এইসব সিনেমা হল আছিল তখন। এখন তো নাই। সামনে লাগানো থাকত ব্যানার। নিচে গেটের কাছে থাকত নায়িকার কাটাউট, লাল-নীল বাত্তি দেওয়া। মানুষ আনন্দ পাইত।’।

 

এখন প্রচারে দীনতা...

সিনেমার প্রচারে এখন চলছে বিশাল দৈন্যতা। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, সিনেমায় দর্শক টানতে এখন শেষমেশ নায়ক-নায়িকাদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে। যেটা আগে কখনো কল্পনাও করা যায়নি। এখন দর্শক টানতে নায়ক-নায়িকাসহ অন্যান্য কলাকুশলীরা স্কুলে-স্কুলে যাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে স্কুলে-স্কুলে গিয়ে সব ধরনের সিনেমার জন্যই প্রচারণা চালানো সম্ভব? মারদাঙ্গা, ভায়োলেন্স প্রভৃতি বাণিজ্যিক সিনেমার প্রচার তো স্কুলে-স্কুলে গিয়ে কোমলমতি শিশুদের মধ্যে সম্ভব নয়। এ ছাড়া ফেসবুকেও চালানো হচ্ছে প্রচারণা।  এতে কি দর্শক সিনেমা হলে আসছে? নির্মাতা গাজী রাকায়েত হোসেন বলেন, এভাবে তারকারা প্রচারে গেলে দর্শক হবে এটা আমি মনে করি না। দর্শক তারকা দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যায় না। দর্শককে বরং আমরা তাড়িয়ে দিচ্ছি। সিনেমার প্রচার নিয়ে বলা যায়, এখন সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই এক ধরনের খরার মতোই হাহাকার চলছে। কারণ যথার্থ প্রচারণার অভাবে সিনেমা হিট করতে ব্যর্থ হচ্ছে নির্মাতারা।

সর্বশেষ খবর