শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ববিতার মুখে যত গল্প

আলাউদ্দীন মাজিদ

ববিতার মুখে যত গল্প

‘প্রথম দৃশ্য : রেললাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছেন গোলাপীরূপী ববিতা। মাথায় লাকড়ির বোঝা। একটি লাকড়ি দোকানের সামনে এসে থামলেন তিনি। বোঝাটি মাথা থেকে ফেলে দিয়ে বসলেন। তার চোখে পড়ল পথে পড়ে থাকা প্রায় নিঃন্ডিষ একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সেটি তুলে মুখে দিয়ে যেন সুখটান দিলেন আর ক্লান্তির ধোঁয়া শূন্যে মিলিয়ে গেল...’। এই ছিল ববিতা অভিনীত আমজাদ হেসেন পরিচালিত সেই অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র শুরুর গল্প। মাত্র ২৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা এ ছবিটিতে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়ে আজও এদেশের মানুষের মণিকোঠায় গোলাপী হয়ে জেগে আছেন। ববিতা যেন এক বিস্ময়। যখন তিনি অভিনেত্রী সেই সময়ের তো বটেই, এ সময়ের অনেক দর্শক যারা আগের সিনেমা দেখেছেন তারা সবাই ববিতা উন্মাদনায় উত্তাল। ববিতা বলেন, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ আমার অভিনয়জীবনের একটি সেরা সিনেমা। এক পর্যায়ে স্মৃতিকাতর হয়ে ববিতা ফিরে যান ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র শুটিং চলাকালীন সময়ে। সুখের স্মৃতি হাতড়ে বলে যান অনেক মজার গল্প। ববিতা বলেন, সিনেমার একটি দৃশ্যে গোলাপী ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় উঠে পড়ে। টিটি এসে বলে, এটি ফার্স্ট ক্লাস, গোলাপীকে টিটি এ কামরা থেকে বের করে দিতে চায়। তখন গোলাপী বলে ওঠে, ‘বাংলাদেশে কোনো কেলাস নাইগো। আমরা হগলেই এক কেলাসের মানুষ।’ ববিতা বলেন, গোলাপীর মুখ দিয়ে যেন পরিচালক তার মনের কথাটাই দর্শককে জানিয়ে দিলেন। এই যে ডায়ালগগুলো, কী অসাধারণভাবেই না আমজাদ ভাই ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার চরিত্রদের মধ্য দিয়ে। সেসময় এসব ডায়ালগ নিয়ে অফিস আদালত পর্যন্ত চর্চা হতো। বলছিলেন স্মৃতিকাতর ববিতা। আরেকটি গল্প হলো- আনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যার দৃশ্যে যথার্থ ভোরের আলোটি ধারণের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করে পুরো ইউনিট। ছবির প্রয়োজনে একটা বাড়ি পোড়াতে হবে। পরিচালক প্রতিদিনই পরিকল্পনা করেন সেট বানাবেন; কিন্তু টাকা নেই। যার বাড়িতে শুটিং চলছিল তিনি বুঝলেন আমজাদ হোসেনের অবস্থা, নিজের আরেকটি বাড়ি বিনামূল্যে পোড়ানোর অনুমতি দিলেন তিনি। ববিতা বলেন, ‘নয়ন মনি’র পরপরই আমজাদ ভাইয়ের এ ছবি করলাম। তার ছবি করার জন্য সব শিল্পীই হাসিমুখে বাড়তি কষ্ট করতেন। এখন শুনতে অবাক লাগবে হয়তো, সে সময় মানিকগঞ্জে খাবার ও থাকার কোনো সুব্যবস্থাই ছিল না। আমরা ফকিরবাড়িতে শুটিং করেছিলাম। গোলাপীর বাড়ি, নদীর পার, খেত সবই ছিল সেখানে। আমি থাকতাম একটু দূরের একটা বাংলো বাড়িতে। শুটিংয়ের ডাক এলে থাকার জায়গা থেকে শীতের মাঝে কখনো লাশকাটা ঘরের পাশ দিয়েও যেতাম। ভালো খাবারও সেখানে পাওয়া যেত না। রাস্তার পাশের খাবার খেয়ে কাজ করেছে

পুরো টিম। যা এখনকার শিল্পী কলাকুশলীদের প্রত্যাশা করা অকল্পনীয়। ছবির কিছু সংলাপ তো দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। গোলাপীকে ছবির নায়ক মিলন [ফারুক] ভালোবাসে, কিন্তু গোলাপীর অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়। বিয়েতে বরপক্ষ যৌতুক হিসেবে একটি সাইকেল চেয়েছিল। গোলাপীর বাবা সাইকেলও আনে। কিন্তু বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য সেই সাইকেল চুরি করে মিলন। বিয়ে ভেঙে যায়। কষ্টে বাকরুদ্ধ গোলাপী বসে আছে। কেউ তাকে কথা বলাতে পারছে না। মিলন এসে গোলাপীকে বলে, ‘একটা কিছু ক গোলাপী একটা কিছু ক।’ ওহ, ফারুক ভাইয়ের মুখে কী এক অসাধারণ অভিব্যক্তিতে এ সংলাপটি জুড়ে দিলেন সিনেমার দক্ষ কারিগর আমজাদ ভাই। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিভিন্ন দেশের উৎসবে গিয়েছিলাম ছবিটি নিয়ে। কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা মৃণাল সেন ছবিটির প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘কী অসাধারণ একটি ছবি, কীভাবে এই ছবি বানালেন আপনারা।’ ববিতা বলেন, গোলাপী আমার অসম্ভব ভালো লাগার একটি চরিত্র। শুটিংয়ে ডিরেকশন দিতে গিয়ে আমজাদ ভাই এভাবে বলতেন, ‘আপনি আর আগের সহজ-সরল গোলাপী নাই, এখন বিড়ি ফুঁকেন, হিন্দি গানও থাকে মুখে।’ বলতে দ্বিধা নেই, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ বাংলাদেশে আমার অভিনীত সেরা ছবি। একবার গ্রামের বাড়ি জামালপুর যাচ্ছিলেন আমজাদ হোসেন। ট্রেনে নানা শ্রেণির মানুষ দেখতে দেখতেই খুঁজে পান ‘দ্রৌপদী এখন ট্রেনে’ উপন্যাসের প্লট। লেখার সময় মাথায় সিনেমার ভাবনাও ছিল। সেই ভাবনা থেকেই ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমাটি  নির্মাণ করেন তিনি। ছবিটি নির্মাণের সময় লগ্নিকারক খুঁজে পেলেন না। তার আগের ছবি ‘নয়ন মনি’ দারুণ সফল হলেও প্রযোজক এ কে এম জাহাঙ্গীর খান ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ প্রযোজনা করতে আগ্রহ দেখাননি। তার মতে, নিম্নবিত্তের সংগ্রামের গল্প দেখতে আগ্রহ দেখাবে না দর্শক। একটু দমে গিয়েছিলেন আমজাদ হোসেন। পরে নিজেই টাকা জোগাড় করে শুরু করলেন শুটিং। বিএফডিসিও যুক্ত হলো। টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে শুটিং হলেও মুক্তির পর হাসি ফোটে ছবি সংশ্লিষ্ট সবার। ছবির নির্মাণ ব্যয় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। প্রদর্শক মিয়া আলাউদ্দিনের মতে প্রায় কোটি টাকা আয় করে ছবিটি। সেরা ছবিসহ ১১টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে গোলাপী এখন ট্রেনে। আমজাদ হোসেনও এ ছবি দিয়ে প্রযোজক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময়ের গ্রামীণ জীবনের করুণ চিত্র সেলুলয়েডে তুলে ধরলেন পরিচালক। গোলাপীদের সংগ্রামের গল্পের পাশাপাশি মোড়লের ছেলেরূপী বিদ্রোহী মিলনও আছে। তার করুণ পরিণতি মনে করিয়ে দেয়, স্বার্থবাদী গোষ্ঠী পথের বাধা দূর করতে নিজের লোককে বলে দিতেও দ্বিধা করে না। ছবিটির ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’ গানের লিরিক লেখা প্রসঙ্গে আমজাদ হোসেনকে নিয়ে ববিতা বলেন, আমরা তখন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র শুটিং করছি। ট্রেন যাচ্ছে জামালপুরের দিকে। এর মধ্যে ট্রেনে বসেই আমজাদ ভাই একটা গান বেধে ফেললেন, একেবারে ইনস্ট্যান্ট বসে। গানটি হলো- ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’। অবাক করার মতো বিষয়। তার মতো ট্যালেন্ট মানুষ খুব কমই ছিলেন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। পরে এ গানটি রেকর্ড করে এ ছবিতেই ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এ গানটিও সেই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ববিতা বলেন, মানিকগঞ্জের নদীতীরবর্তী এক গ্রামে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার শুটিং। সেখানে মেকআপ নিয়ে সারা দিন অপেক্ষায় আমি। অন্য শিল্পীরা শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করলেও আমার ডাক আসে না। যখন ডাক আসে, তখন রাত ২টা। কনকনে শীতের মধ্যে ওই রাতে আনন্দচিত্তেই সংলাপ দিতে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। কারণ, ছবির পরিচালক আমজাদ হোসেন।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর