মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

আজও শূন্য নায়করাজের আসন

আজও শূন্য নায়করাজের আসন

বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক, নায়করাজ রাজ্জাকের জন্মদিন আজ। রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে থাকলে আজ তিনি ৮২ বসন্ত পূর্ণ করতেন। ২০১৭ সালে তাঁর চির প্রস্থানের পর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত তার রাজা-ধিরাজের আসনটি কেউ পূর্ণ করতে পারেনি। নায়করাজের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

নায়করাজের জন্মদিনে বন্ধ থাকত এফডিসি। একটা সময় ছিল যখন ঢাকার ছবির অঙ্গনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। দিনটি হলো নায়করাজ রাজ্জাকের জন্মদিন। দুপুরের দিকে এফডিসির দারোয়ানসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী গুলশানে রাজ্জাকের রাজলক্ষ্মী ভবনে নিমন্ত্রণে যেতেন। সন্ধ্যা থেকেই আসতে শুরু করতেন তারকা শিল্পী, নির্মাতা ও প্রযোজকরা। রাতভর চলত আড্ডা, হইচই, আলোচনা। আসতেন জহির রায়হান, আলমগীর কুমকুম, মোস্তাফিজুর রহমান, এহতেশাম, কবরী, শাবানা, ববিতা, সুচন্দা, আলমগীর, ফারুক, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো গুণী তারকারা।

 

রোগা-পাতলা ছেলেটিই হলেন রাজাধিরাজ

নায়করাজের আগে যারা নায়ক হিসেবে অভিনয় করতেন সবাই ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব। আনোয়ার হোসেন, খলিল, শওকত আকবর। একটা সময় তাদের দর্শক কলেজপড়ুয়া রোমান্টিক হিরো হিসেবে মানতে পারত না। তখন রাজ্জাক রোগা-পাতলা একজন যুবক। অনেক প্রযোজক তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে অফিস থেকে চলে যেতে বলেন। পরে সেসব পরিচালকই তাকে নিয়ে ছবি করেছেন। এটা ছিল নায়করাজের জীবনে বড় প্রাপ্তি। রোগা-পাতলা হলেও রাজ্জাকের চেহারা ফটোজেনিক ছিল বলে সহজেই দর্শক-নির্মাতারা তাকে লুফে নিলেন। আরেকটি বিষয় ছিল- এমন মেলোড্রামার ক্ষেত্রে নায়করাজের দক্ষ অভিনয়ের কোনো তুলনা ছিল না। তাই একবার কলকাতার এক নির্মাতা সেখানকার জনপ্রিয় অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জিকে একই ছবিতে নায়করাজের সঙ্গে কাস্ট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভিক্টর ব্যানার্জি রাজি হলেন না। তিনি নির্মাতাকে বললেন, রাজ্জাক সাহেবের মেলোড্রামাটিক অভিনয়ের ধারে-কাছে কেউ যেতে পারবে না। এ জন্যই তার সঙ্গে আমার অভিনয়ের প্রশ্নই ওঠে না। আমি তো তার সামনে দাঁড়াতে পারব না।

 

সময়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে সফল হলেন

অনেক রোগা-পাতলা ছিলেন বলে লোকে ভাবত এই ভাঙাচোরা ছেলে দিয়ে কী হবে! যাক, কিন্তু তিনি রোমান্টিক হিরো হয়ে পর্দায় আসতেই দর্শক লুফে নিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলেছেন নায়করাজ। যুদ্ধের পর দেখলেন দেশের যুবকদের মধ্যে একটা পরিবর্তন। তারা অনেক ফাস্ট হয়ে গেছে। ওরা যুদ্ধ দেখেছে। রক্ত দেখেছে। অভাব দেখছে। কাজ নেই। হাতে পয়সা নেই। সমাজ তাদের জন্য কিছু করতে পারছে না। একটা অস্থিরতা সবখানে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়াচ্ছে। রাজ্জাক তখন সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের ইমেজটাকে ভেঙে নতুন করে দাঁড় করাবেন। ‘রংবাজ’ ছবিটি প্রযোজনা করলেন। সমাজের অবহেলিত এক যুবকের অস্থিরতা, হতাশা ও সমাধানের গল্প। ছবিটি করার সময় তাঁকে কাছের পরিচালক ও প্রযোজকরা বাধা দিলেন। এটা করবেন না আপনি। দর্শক আপনাকে রোমান্টিক হিরো হিসেবে, আদর্শ যুবক হিসেবে মানে। তারা আপনার হাতে অস্ত্র, মদের বোতল এসব গ্রহণ করবে না। কিন্তু রাজ্জাকের মধ্যে বিশ্বাস ছিল, সময় বদলে গেছে। সময়কে ধরতে হবে। দর্শক কলকাতায় গিয়ে হলে হিন্দি ছবি দেখছে। তবে নিজের দেশের নায়ককে সে সব চরিত্রে পেলে কেন দেখবে না। সত্যি তাই হলো। ‘রংবাজ’ সুপার ডুপার হিট হলো। এরপরই ‘বেঈমান’ ছবিটি করলেন। সেটিও সুপারহিট। সবাই বুঝতে পারল এই দূরদর্শী মানুষটির ভাবনা অমূলক ছিল না। একজন হিরোকে এভাবে সময় ধরতে জানতে হয়। প্রযোজক-পরিচালকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ীই ভাববেন। কিন্তু হিরোকে ভাবতে হয় সময় কী চাইছে। সেটা রাজ্জাক পেরেছিলেন বলেই তিনি সহজেই নায়কদের রাজা হয়ে উঠেছিলেন।

 

নতুনদের স্বাগত জানালেন

নায়করাজ জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এক সময় একটা হলে গিয়েছিলাম ছদ্মবেশে। ছবিতে আমার তখন রোমান্টিক সিন চলছিল। দর্শক মজা করে চিৎকার করে উঠল- আংকেল আর কত। দিনে দিনে বেলা তো কম হলো না! ওই কথায় আমি বুঝলাম নিজের বয়স হচ্ছে। এসব প্রেমিক চরিত্রে দর্শক আমাকে আর চায় না। আমি নতুন নায়ক নিয়ে আসতে পরিচালক ও প্রযোজকদের পরামর্শ দিলাম। আলমগীর, ফারুক, সোহেল রানারা এলো। এদের সমসাময়িক প্রায় সবাই আমার হাত ধরে এসেছে। কোনো না কোনোভাবে তাদের চলচ্চিত্রে আগমনে আমার কন্ট্রিবিউশন আছে। আমি এটা কেন করলাম? আমি চেয়েছি ইন্ডাস্ট্রি যেন শূন্যতায় না ভোগে। আমি চলে যেতে যেতে যেন আরেকটা সার্কেল দাঁড়িয়ে যায়। হলোও তাই। ওরা সবাই সুপারহিট ছবি দিল। আমিও তাদের অনেকের সঙ্গে অভিনয় করলাম। আমার নায়িকারাই তাদের নায়িকা হলো। কবরী, ববিতা, শাবানা, রোজিনারা সফল হলো ওদের সঙ্গে। ইন্ডাস্ট্রিতে শূন্যতা আসেনি। আমার এই প্রজন্মের পরপরই জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনরা এলো। বেশ শক্তভাবেই তারা হাল ধরল। কাঞ্চনের দুটো ছবি করে ফ্লপ হলো। সবাই নিরাশ হলো নতুন মুখ নিয়ে। কাঞ্চনকে বাসায় ডেকে আনলাম। দেখলাম সেও হতাশ। আমি সাহস দিলাম। বললাম আবার শুরু কর। হলো কিন্তু। ইন্ডাস্ট্রিতে কাঞ্চনের মতো জনপ্রিয়তা বা স্টারডম খুব কম নায়কই দেখেছে। এগুলো আমার করার কী দরকার ছিল বলো? আমি নিজে সুপারস্টার। ইন্ডাস্ট্রির সবাই আমাকে সম্মান করে। কী দরকার ছিল এসবের? শুধুই চলচ্চিত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য। নতুনদের নিয়ে কাজ করতে আমার অনেক আগ্রহ ছিল। আমি নিজে অনেক নতুন নায়িকার সঙ্গে কাজ করেছি। শাবানাকে পরিচালকরা নিতে চাইত না। কারণ সে উর্দু ছবিতে বেশ নাম করেছিল। আমি বললাম ও বাঙালি মেয়ে। ওকে অবশ্যই আমাদের ছবিতে নেওয়া উচিত। নেওয়া হলো। বাকিটা ইতিহাস। তখন কেউ কেউ আমাকে বকতেন আমি নাকি কবরী, শাবানা, ববিতার দালালি করি। শবনমকে সুযোগ দেই না। শবনম ইজ নাইস লেডি। খুব ভালো মানুষ উনি। আগেও যেমন ছিলেন, এখনো তেমনই। আমি পরিচালকদের বললাম, আপনারা ভুল বলছেন। আমি শবনমকেও ইন্ডাস্ট্রিতে চাই। তার সঙ্গে ছবি করব। করেছি। শুধু তাই নয়, তখন অনেক নতুন সংগীত শিল্পীও আমার ইশারায় ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে। একদিন এক পরিচালক খুরশিদ আলমকে নিয়ে এলেন। রোগা-পাতলা একটা লোক। বলে সিনেমাতে গান করব। আমি তো দেখেই বলি আরে না, হবে না। পরিচালক বললেন একটা গান শুনে দেখুন। শুনলাম। সত্যি ভালো লাগল। তিনি ছবিতে গাইলেন এবং কালজয়ী শিল্পীদের তিনিও একজন আজ। এমন অনেককেই আমি ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে এসেছি। নতুনদের সুযোগ দিতে হবে। তাদের নিয়ে রিস্ক নিতে হবে। ভালো করে বড় আয়োজনে উপস্থাপন করতে হবে। দর্শকদের মনে প্রভাব ফেলতে হবে। তবেই দর্শক হলে আসবে।’ আসলেই তাই, নায়করাজের এমন সময়োপযোগী দূরদর্শী চিন্তা-চেতনার পথ ধরেই আজো এ দেশের চলচ্চিত্র জগৎ এগিয়ে যাচ্ছে।

 

ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক ছিলেন নায়করাজ। তাঁর শূন্যতায় এই ইন্ডাস্ট্রি এখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। হারিয়েছে শৃঙ্খলা। জীবদ্দশায় নায়করাজ বলেছিলেন, ‘আগে এত অ্যাসোসিয়েশন ছিল না। কেবল প্রযোজকদের একটা সংগঠন ছিল। সব কিছু আমাকে সামলাতে হয়েছে। কারও কোনো ঝামেলা হলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি সমাধান দিতাম। একবার মেকআপ রুমে গিয়ে দেখলাম চেয়ার ভাঙা। মেজাজ খুব খারাপ হলো। এত পরিশ্রম করি। দিনে বিশ ঘণ্টা শুটিং করি। কার জন্য। এফডিসিতে দুটি ভালো চেয়ারও থাকবে না। শাবানাকে নিয়ে গেলাম এমডির রুমে। গিয়ে ভাঙা চেয়ারটা রেখে তার ভালো চেয়ারটা নিয়ে এলাম। তিনি তো রেগে আগুন। আমাকে এসে বললেন, কেন এমনটা করলেন? বললাম, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাব আর এসির বাতাসে হুইল চেয়ারে বসে আরাম করবেন আপনি? তিনি লজ্জা পেলেন। পুরো এফডিসি ঘুরে দেখলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই এসি, চেয়ারের ব্যবস্থা করলেন। আরও মজার কথা বলি, ইন্ডাস্ট্রিতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিন ছিল আমার জন্মদিন ও আমার মেয়ের জন্মদিন। এই দিনগুলোতে সবাই আসত। অনেকে আসত সমস্যা নিয়ে। আমার বাসায় বসেই সব সমাধান হতো। একবার এক পরিচালক তার প্রযোজককে নিয়ে এলেন জন্মদিনের পার্টিতে। তিনি জাফর ইকবালের নামে অভিযোগ করলেন। দুই দিন পর শুটিংয়ের শিডিউল দিয়ে জাফর ইকবাল মাথার চুলে রং দিয়ে লাল করে ফেলেছে। এখন কী হবে। জাফর ইকবালও পার্টিতে ছিল। তাকে ডেকে বললাম এটা কেন করলি। তোর শখ করতে ইচ্ছে করে শুটিং শেষ করে করিস। জাফর ইকবাল বলল আচ্ছা, আমি কাল চুল কালো করে ফেলছি। এরকম ঘটনার শেষ নেই।’

 

আজাচৌ বললেন, ‘তুমি আমাদের নায়করাজ’

নায়করাজ বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় শত্রু সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী [আজাচৌ] খোকাভাই। ওর সঙ্গে কথা-কাটাকাটিই নয়, মারামারি পর্যন্ত হয়েছে আমার। তবুও আমার প্রাণের বন্ধু সে-ই। যখনই মন খারাপ হয়েছে তাকে ডেকেছি। সেও আসত। দুজনে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমার যে নায়করাজ উপাধি সেটিও ও দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম এই উপাধি কেন? উত্তর দিল-উত্তম কুমার যদি ওপার বাংলার মহানায়ক হতে পারে, তুমিও আমাদের নায়করাজ। আমার বন্ধু আজ আর নেই। আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করুন।’

সর্বশেষ খবর