শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে সত্যজিতের ‘নায়ক’ উত্তম

যেভাবে সত্যজিতের ‘নায়ক’ উত্তম

সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুর ও উত্তম কুমার

উত্তম কুমার টলিউডের মহানায়ক। আর সত্যজিৎ রায় সর্বকালের সেরা পরিচালক। এ দুই কিংবদন্তি একসঙ্গে কাজ করেছিলেন মাত্র দুবার।  ‘নায়ক’ ছবিতে সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমারকে নিয়েছিলেন। নায়ক ছবির গল্পটা সত্যজিৎ রায় ভেবেছিলেন উত্তমের কথা মাথায় রেখেই। উত্তম-সত্যজিৎ জুটির সাত সতের তুলে ধরেছেন-আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সাড়ে চুয়াত্তর দেখলেন সত্যজিৎ

সত্যজিৎ রায় তখনো ছবি বানাতে শুরু করেননি, তার আগেই উত্তম টলিউডে নিজের জায়গা করে ফেলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় লোকমুখে শুনেছিলেন টলিউডে এক নতুন তারকা এসেছে। ভবিষ্যতে এ ছেলেটিই সেরা অভিনেতা হবে। এ কথা শুনে সত্যজিৎ রায়ের মনে উৎসাহ জাগে। তিনি উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখতে যান। এবং ছবি দেখেই উত্তমকে মনে ধরে যায় সত্যজিতের। সত্যজিৎ এর পর তিন তিনটি উত্তমের ছবি দেখে ফেলেন। তার মনে হয়েছিল বাংলার অন্য অভিনেতা থেকে এ ছেলে একেবারে আলাদা।

ক্যামেরাকে যেন এ ছেলে চোখেই দেখে না। নিজের ছন্দে সাবলীলভাবে অভিনয় করে চলে। তখনই সত্যজিৎ ভাবেন উত্তমকে নিয়ে ছবি করার কথা। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘নায়ক’-এর গল্প আমি ভাবি উত্তমকে দেখেই। নায়কের গল্প শুনেই উত্তম রাজি হয়ে গিয়েছিলেন অভিনয় করতে। আর সেই জন্যই ‘নায়ক’ উত্তমের জীবনের সেরা একটি ছবি।

 

উত্তমকে কেন মেকআপ দেননি

১৯৬৬ সালে ‘নায়ক’ ছবিটি করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমারকে কোনো মেকআপ করাননি। উত্তম কুমারের গালের বসন্তের দাগগুলোই সত্যজিৎ রায় দেখাতে চেয়েছিলেন সিলভার স্ক্রিনে, যা শুনে ভয় পেয়ে যান উত্তম।

কিন্তু উত্তম কুমারের সেই লুকই তার চলচ্চিত্র জীবনের শ্রেষ্ঠ লুক হয়ে গেল। আসলে একজন হিরোর ‘নায়ক’ ইমেজের হাজার আলোর ঝলকানির নিচে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত, ভাঙাচোরা, বিপর্যস্ত, নিঃসঙ্গ মনটাকেই দেখাতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।

 

সত্যজিতের দুই ছবিতে উত্তম

তিন দশক ধরে টলিউডে রাজত্ব করেছেন মহানায়ক উত্তম কুমার। একের পর এক সুপারহিট ছবিতে কাজ করেছেন তিনি।

কিন্তু বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন বহু দেরিতে। প্রথমবার ‘নায়ক’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেন উত্তম এবং সত্যজিৎ। ১৯৬৭ সালে সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতেও ব্যোমকেশের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল উত্তমকে। অস্কারজয়ী পরিচালক এবং মহানায়কের যুগলবন্দিতে এ দুটি ছবিই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘হল অব ফ্রেমে’ জায়গা করে নিয়েছে।

 

সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’র নায়ক হলেন না উত্তম

‘নায়ক-এর বহুদিন আগে ‘ঘরে বাইরে’ ছবির জন্য উত্তম কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৬ সালে আচমকাই অসুস্থ হয়েছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক। সেই সময় বেশ কিছুদিন বাড়িতে থাকতে হয়েছিল তাকে।

ওই সময়কে কাজে লাগিয়েই ‘ঘরে বাইরে’ তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসকে চিত্রনাট্য আকারে লিখে ফেলেছিলেন। উত্তম কুমারকে সন্দীপের চরিত্রে ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গেই ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন উত্তম। এ অভিনেতা সেই সময় প্রথিতযশা নায়ক। ফলে তিনি নাকি নেগেটিভ শেডের ওই চরিত্রে কাজ করতে চাননি।

 

নায়ক ছবির মজার যত গল্প

নায়ক ছবির মুক্তির দিনের মজার একটি গল্প জানিয়েছিলেন উত্তমের স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবী। ভবানিপুরের ইন্দিরা সিনেমাতে ছিল সিনেমাটির প্রিমিয়ার শো। তিনি আর উত্তম কুমার মধ্যপথের মোড়ে পৌঁছে দেখেন হাজার হাজার মানুষের মাথা। অনেক কষ্টে শোতে ঢোকেন তারা। শো শেষ করে তারা যখন বের হচ্ছিলেন জনতা ‘গুরু, গুরু’ বলে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। এতে উত্তমের শার্টের একটা হাতা ছিঁড়ে বেরিয়েই গেল। ওদিকে ছিঁড়ে গেল সুপ্রিয়া দেবীর শাড়ির আঁচল। কোনোমতে ওই অবস্থায় গাড়িতে ওঠে তারা সোজা গ্র্যান্ড হোটেলে এসে বাঁচলেন। ওদিকে নায়ক ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য, উত্তম কুমার টাকার পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছেন।

দৃশ্যটির জন্য প্রচুর নকল নোট ছাপানো হয়েছিল যা ব্যবস্থা করেছিল প্রোডাকশনের লোকেরাই। কিন্তু এখন দেখা গেল, রিজার্ভ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নোট ছাপানো হয়েছে বলে প্রযোজকের নামে এসেছিল অভিযোগ। নায়কের একটি দৃশ্যে পকেট থেকে কলম বের করে লিখবেন অরিন্দম।

ওদিকে ফুরিয়ে গেল কলমের কালি।

সত্যজিৎ যেই কাট বলতে যাবেন, তার আগেই হালকা ঝাঁকি দিয়ে আবার সই  করার চেষ্টা করলেন উত্তম। তাতেও বিফল হয়ে সামনে থাকা গ্লাসের পানিতে কলম চুবিয়ে সাইন করলেন। উত্তমের এ ইমপ্রোভাইজেশনটা দেখে প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।

সর্বশেষ খবর