মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

জহিরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডেকে নেওয়া হয়

সুচন্দার স্মৃতি কথা

জহিরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডেকে নেওয়া হয়

আজ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ৫২তম অন্তর্ধান দিবস। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে আর ফিরে আসেননি তিনি। তাঁর অন্তর্ধান দিবসে জহির রায়হানের সহধর্মিণী চলচ্চিত্রকার কোহিনূর আক্তার সুচন্দার বলা স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যেভাবে জহিরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল

১৯৬৬ সালে আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। পরিতাপের বিষয়, বিয়ের মাত্র সাত বছরের মধ্যে তাঁকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। এসেই জানতে পারেন তাঁর অগ্রজ কথাশিল্পী শহীদুল্লাহ কায়সার নিখোঁজ। ভাই শহীদুল্লাহকে ঢাকার প্রায় সব জায়গায় খুঁজে ব্যর্থ হন জহির। ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওইদিন জহির রায়হানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুর ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে তিনি বাসায় ছিলেন। কয়েকজন লোক এসে তাঁকে বলে শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে পাওয়া গেছে। বাসার সামনে আর্মি অফিসার ও তাঁর চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির অপেক্ষা করছিলেন। ও চলে গেল।  ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি সে যাওয়াই হবে জহিরের শেষ যাত্রা। ঘরময় নেমে এলো বিষাদের নীরবতা আর ভয়ার্ত অন্ধকার। সন্ধ্যায় বাসায় সবাই নিশ্চুপ বসে আছি। মনে অজানা ভীতি কাজ করছিল। মিরপুর থানায় ফোন করলাম। কেউ একজন বলল কিছুক্ষণ পর ফোন করেন, তিনি এখন নেই। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলাম। তখন ফোন রিসিভ করলেন মেজর মঈন। তাকে জহিরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মেজর মতিউরকে ফোন ধরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন তিনি ব্যস্ত, এখন দেওয়া যাবে না। আবার ফোন দিলাম। কে একজন জানালেন মিরপুরে গোলাগুলি হয়েছে, জহিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনকে এই বলে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, ‘জহিরকে সবাই চেনে। স্বাধীন দেশে তাঁকে কেউ কিছু করবে না। ও নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।’ ওর জন্য সবাই অপেক্ষা করতে থাকি। ও আর ফিরে আসে না। কান পেতে থাকি, ওই বুঝি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, এক্ষুনি ডাকবে। কিন্তু না, এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। ক্যান্টনমেন্ট গেলাম। মেজর মঈন ও মতিউরের সঙ্গে দেখা করলাম। তারা বললেন, ওইদিন মিরপুরে অপারেশন হয়েছে। কোথায় গেছেন, কী হয়েছে তাঁর, কিছুই জানেন না তারা। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলাম, কয়েক দিন পর মিরপুর থানায় গেলাম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য পুলিশের সাহায্য চাইলাম। পুলিশ দুজন অবাঙালিকে ধরে আনল। তাদের বর্ণনায় সেদিন বিহারিদের সঙ্গে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়েছিল সেখানে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ তাদেরসহ আমাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। আশপাশের কয়েকটি কলাগাছের নিচে মাটি খোঁড়া হলো। বেরিয়ে এলো অসংখ্য লাশ। লাশের গায়ে কাপড় নেই। পচে বীভৎস হয়ে গেছে। চেনারও উপায় নেই। এরপর পুলিশ একটি কুয়ার কাছে নিয়ে গেল। লাশ ভর্তি ছিল কুয়াটি। আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কোথাও জহির রায়হানকে খুঁজে পেলাম না। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেল। নিশ্চিত হলাম জহির রায়হানকে হারিয়ে ফেলেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি সান্ত্বনা দিলেন। আমার থাকার কোনো জায়গা ছিল না। পরে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে বনানীতে একটা বাসা পাই। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকার বাসাটি নিয়ে নেয়। সন্তানদের নিয়ে আবার রাস্তায় নামতে হয়। জহির রায়হান তো আমার জন্য কিছু রেখে যাওয়ার সময় পাননি। অনেক কষ্টে দিনযাপন করেছি। কেউ আমাদের কখনো খোঁজ নেয়নি। আমি নিজেও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। জীবনের সব হারিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেয়েছি। জানি জহির রায়হানকে আর কোনো দিন খুঁজে পাব না। তাঁর বিনিময়ে এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশই আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা।

 

জহির রায়হানের মূল্যায়ন হয়নি

জহির রায়হানের কোনো মূল্যায়ন হয়নি। জহির রায়হান নির্মিত ছবিগুলো মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট নিয়ে নিল। ছবিগুলো বা এর জন্য একটি পয়সাও দিল না। বড় কষ্ট হয়, জহির রায়হানের সম্পদ তাঁর উত্তরাধিকারীরা কেন পাবে না। নিজ দেশে জহির রায়হানের কোনো মূল্যায়ন হলো না। ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় একবার জহির রায়হানের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার মতো মেধাবী একজন মানুষের জন্ম ভারতে কেন হলো না।’

 

বঙ্গবন্ধুর সান্ত্বনার কথা ভুলতে পারব না

জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই মায়ার পরশ এখনো অনুভব করি। জাতির জনক কত যে মহান ছিলেন যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। সেদিন মনে হয়েছিল জাতির পিতা যেন আমারও পিতা। তাঁর উদার মনের ভালোবাসার কথা কোনো দিনও ভুলব না। জাতি হিসেবে সত্যিই আমরা ভাগ্যবান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ আমাদের বঙ্গবন্ধু।

 

জহির রায়হানের নামে একটি ট্রাস্ট করব

জহির রায়হান ছিলেন সৃষ্টিশীল কর্মের অধিকারী মানুষ। তাঁর নামে একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করব। তাঁর অসমাপ্ত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। ছবিটির ডাব করা বাকি আছে শুধু। এই কাজটি সম্পন্ন করে ছবিটিকে আলোর মুখ দেখানোর উদ্যোগ নিচ্ছে আমাদের সন্তানরা। নতুন প্রজন্মের কাছে জহির রায়হানকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য পারিবারিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি। জহিরের কালজয়ী উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’সহ অন্যান্য রচনার চলচ্চিত্রায়ণের পরিকল্পনা রয়েছে আমার।

সর্বশেষ খবর