রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রের চালচিত্র

চলচ্চিত্রের চালচিত্র

দেশীয় চলচ্চিত্রের অবস্থা বর্তমানে খুব একটা সুখকর নয়। গত বছরের ঈদের পর থেকে কোনো ছবি ব্যবসা করেনি।  এফডিসিতে তিন মাসের বেতন নেই। সিনেমা হল উন্নয়ন দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে। এসব প্রতিকূল অবস্থা তুলে ধরছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

এফডিসিতে তিন মাসের বেতন বাকি

‘তিন মাস ধরে বেতন পাইনি। ভাড়া বাসায় থাকি, ভাড়া দিতে পারছি না। বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। হাতেপায়ে ধরে আর কত দিন থাকা যায়, অপমানিত হয়েও থাকছি।’ এ আক্ষেপ এফডিসির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মোহাম্মদ বদরুজ্জামানের। কর্মকর্তা থেকে মালি, ক্লিনার, নিরাপত্তারক্ষীসহ এফডিসির ২১২ কর্মী গত তিন মাস ধরে (নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি) বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

এমন দুরবস্থা এক কথায় এফডিসির কর্মকর্তা- কর্মচারী সবারই। অসুস্থ অনেকে চিকিৎসা করাতে বা ওষুধ কিনতে পারছে না। অনেকে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে ও বেতন দিতে পারছে না। সবই অর্থের অভাবে। এফডিসির এমডি নুজহাত ইয়াসমিন জানান, অনেক আগেই তথ্য মন্ত্রণালয়ে বেতন পরিশোধের জন্য অর্থের আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফাইলটি আটকে থাকায় টাকা আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় কী কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে এফডিসির সিবিএভুক্ত কর্মচারীরা ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেতন না পেলে ধর্মঘটে যাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে।

 

ঈদের পর দর্শক টানতে পারছে না ছবি

গত বছরের ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো সর্বশেষ বেশ ভালোই ব্যবসা করেছিল। এরপর এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো লগ্নিকৃত মূল টাকাই ফেরত আনতে পারেনি, এমন তথ্য হল মালিক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির। কথা হয় স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া ও মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মেসবাহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঈদের পরে বাংলা ছবিগুলো মানের অভাবে দর্শক পায়নি। একমাত্র ‘একাত্তরের সেইসব দিন’ ছবিতে দর্শক কিছুটা পেয়েছি। মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ আক্ষেপ করে বলেন, গত ঈদুল আজহার পর থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া কোনো ছবিই লাভের মুখ দেখেনি। হলের খরচও ওঠেনি।

 

সিনেমা হলের উন্নয়ন নেই

ছবি প্রদর্শনের জন্য দর্শক- উপযুক্ত সিনেমা হল প্রয়োজন, তাই সরকার এ দিকটায়ও নজর দিয়েছে। ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনেমা হল নির্মাণে ঋণ তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। তখন বন্ধ হয়ে যাওয়া হলের সংস্কার ও নতুন সিনেমা হল তৈরিতে স্বল্প সুদে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার উদ্যোগের কথা জানায় সরকার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঋণ তহবিলের পরিমাণ বাড়িয়ে ১ হাজার কোটি টাকা করা হয়। পরবর্তীতে ৫০০ কোটি টাকা প্রথম পর্যায়ে ছাড় করানো হয়। এ ঋণ বিতরণে সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের দায়িত্ব দেয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির অভিযোগ, বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও শুধু ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে ঋণ পাচ্ছে না সিনেমা হল মালিকরা।

প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস জানান, এখন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে ৩৫টি, সোনালী ব্যাংকে ৫টি ও রূপালী ব্যাংকে ৪টি আবেদন ও প্রজেক্ট প্রোফাইল জমা পড়ে আছে। কিন্তু ব্যাংকের নানা টাল বাহানার কারণে ঋণের দেখা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক ঋণ প্রদানে যে ৩৭টি অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করেছে তা কারও পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয় বিধায় এ আবেদনটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দেশের প্রায় অর্ধশত সিনেমা হল মালিকের প্রজেক্ট প্রোফাইল বছরের পর বছর আটকে রেখে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে সরকারের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করছে ব্যাংক। প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জল বলেছেন, ব্যাংকের নানা শর্তের মধ্যে রয়েছে- জমি বন্ধক দিয়ে যে ঋণ চাওয়া হবে তার ৫ পার্সেন্ট অর্থ আগে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এ ছাড়া যারা নতুন সিনেমা হল করার জন্য ঋণ চাইবে তাদের আগে ভবন নির্মাণসহ ৪০ ভাগ কাজ ঋণ পাওয়ার আবেদন করার আগে সম্পন্ন করতে হবে। এসবসহ আরও অনেক কঠিন শর্ত আবেদনকারীদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় দেখে- একটি হলো জমির মালিকানা ঠিক আছে কি না, অন্যটি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা। এর বাইরে অযৌক্তিক শর্ত দিয়ে সিনেমা হল উন্নয়ন থামিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না।

কিন্তু  ব্যাংক নানা অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করছে বলে সিনেমা হল মালিকরা এ ঋণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আরেকটি ভীতি হলো, উচ্চ সুদের হার বেঁধে দেওয়া। সরকার যেভাবে সাড়ে ৪ পার্সেন্ট সুদের হার বেঁধে দিয়েছে তাতে একজন সিনেমা হল মালিক এ ঋণ নিয়ে তা কীভাবে পরিশোধ করবেন? এদিকে কয়েকটি সংশ্লিষ্ট ব্যাকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ম্যানেজাররা জানাচ্ছেন, এখন যেসব ছবি নির্মাণ হয় সেগুলো দর্শক দেখে না। ছবি যদি সিনেমা হলে না চলে তাহলে সিনেমা হল মালিকরা এ ঋণের টাকা ফেরত কীভাবে দেবেন। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তফশিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা বেঁধে দিয়েছে যে, বিতরণকৃত ঋণের টাকা যদি সংশ্লিষ্ট সিনেমা হল মালিকরা পরিশোধ করতে না পারেন তাহলে সেই টাকা প্রদানকৃত তফশিলি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কেটে নেবে। ফলে ঋণ বিতরণে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই আগে আমাদেরই দেখতে হবে, জানায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।

এদিকে আবারও নানা সমস্যার দোলাচলে পড়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি এখন দেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্র বলে জানান চলচ্চিত্র বোদ্ধারা।

সর্বশেষ খবর