মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়ার বিদায়ের দিন

নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়ার বিদায়ের দিন

এই উপমহাদেশের জনপ্রিয় গায়িকাদের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর অন্যতম। শুধু জনপ্রিয় বললে ভুল হয়, তিনি ছিলেন ভারতরত্ন। ভারতরত্ন থেকে শুরু করে পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে সম্মান, সবই রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তাঁকে একদিকে যেমন ‘ডটার অব দ্য নেশন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েচে ঠিক তেমনি আবার ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ উপাধিতেও আখ্যায়িত করা হয়। ৩৬টি ভাষায় ৩০ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন। বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে ২০২২ সালের এই দিনে চলে গেছেন তিনি অমৃতলোকে। লতা চলে গেলেও তাঁর সুরেলা গলা এখনো ঘরে ঘরে মানুষের মন ও কানকে দেয় আরাম আর আনন্দ। তার চির প্রস্থানের দিনে এই সুরসম্রাজ্ঞীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

লতার এক ভক্তের কান্ড

দেশের মানুষের কাছে বিশেষ করে সংগীতপ্রেমীদের কাছে তিনি ঈশ্বরের থেকে কিছু কম নন। লতার এক পাগল-ভক্ত রয়েছে, যার নাম রাজীব দেশমুখ। গায়িকার যে কোনো কনসার্টেই দেখা যেত রাজীবকে। আর তারপর তো নিজের বাড়িতেই লতার নামে মন্দির স্থাপন করেন এই ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, লতাকে দেবী-রূপে পুজোও করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লতা মঙ্গেশকর। আর লতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গত বছর মন্দিরটি তৈরি করেছেন রাজীব। মন্দিরের ভিতরে লতা মঙ্গেশকরের একটি মূর্তি  রয়েছে। রাজীব এবং তার পরিবার প্রতিদিন লতার পূজা করেন। গলায় মালা দেওয়া হয় লতার। রাজীব নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা একটি গানও বাজায় আরতির সময়। এক সাক্ষাৎকারে, রাজীবকে প্রয়াত গায়িকার প্রতি নিজের ভালোবাসা জাহির করতে দেখা গেছে। তিনি প্রকাশ করেছিলেন, যে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দেখা করতে মুম্বাই আসবেন বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। রাস্তায় পুলিশ তাকে একা দেখার পর বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৮২ সালে রাজীব যখন লতার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন তিনি একটি অনুষ্ঠানের জন্য বিদেশে। অবশেষে ১৯৮৭ সালে রাজীব সুযোগ পান লতাকে কাছ থেকে দেখার। তিনি এই সাক্ষাৎকারেই জানান, সেই দিনই তিনি অনুভব করেছিলেন যে তার স্বপ্নপূরণ হয়েছে। রাজীবের স্ত্রী শুভাঙ্গীও জানান যে, লতা মঙ্গেশকর তাদের কাছে দেবীর মতো ছিলেন এবং সারাজীবন থাকবেন। এবং তার প্রতি তাদের অনেক শ্রদ্ধা রয়েছে। সবাই যাতে দেখতে পায় সেজন্য তারা মূল হলে লতার ছবিটি রেখেছেন।

 

লতাকে ‘মিট্টু’ ডাকতেন তাঁর প্রেমিক

প্রেমের ব্যর্থতাই কি আরও বেশি করে সংগীতকে আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করেছে? শোনা যায়, দুঙ্গারপুরের রাজ ঘরানার মহারাজ রাজ সিংয়ের প্রেমে পড়েছিলেন লতা। কিন্তু কোনো দিন বিয়ে করেননি এই সুরসম্রাজ্ঞী। শুধুই কি গানের জন্য দাম্পত্যকে জীবনে আনলেন না এই সাধিকা? লতা মঙ্গেশকর নামের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে। লতার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবেই বিসিসিআইর প্রাক্তন সভাপতি রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরের সঙ্গে লতার পরিচয়। লতার গানে মুগ্ধ ছিলেন রাজ সিংহ। কিন্তু সেই প্রেম গভীর বন্ধনে পৌঁছায়নি। রাজ ঘরানার ছেলে রাজ সিংহ নাকি বাবা-মাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কোনো সাধারণ পরিবারের মেয়েকে তিনি রাজবংশের বউ করে আনবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা বজায় রেখেছিলেন রাজ সিংহ। তিনিও আর বিয়ে করেননি। লতার চেয়ে ছয় বছরের বড় রাজ সিংহ আদর করে লতাকে ‘মিট্টু’ বলে ডাকতেন। তার পকেটে সব সময় থাকত একটি রেকর্ডার। তাতে রেকর্ড করা থাকত লতা মঙ্গেশকরের জনপ্রিয় কিছু গান। ২০০৯ সালে প্রয়াত হন লতার জীবনের অন্যতম কাছের মানুষ, রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর।

 

গানপ্রতি পারিশ্রমিক

মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে হয় বড় মেয়ে লতাকে, সালটা ছিল ১৯৪২। নবযুগ চিত্রপট সিনেমা কোম্পানির মালিক মাস্টার বিনায়ক লতাকে গায়িকা ও অভিনেত্রী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন। প্রথমে মারাঠি ছবিতে কণ্ঠ দেন লতা? কিন্তু প্রথম ছবিতে তাঁর গাওয়া গান পরবর্তীতে ব্যবহারই করা হয়নি সিনেমায়। লতা মঙ্গেশকরের যে গানে ভেসেছিল গোটা উপমহাদেশ সেট ছিল ‘মহল’ ছবির ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। পারিশ্রমিকের বিষয়ে প্রথম থেকেই লতা মঙ্গেশকর ছিলেন শীর্ষে। তিনি তাঁর প্রথম গানের জন্য পেয়েছিলেন সেই যুগে প্রায় ৫০০ টাকা। লতা মঙ্গেশকর তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রতি গান পিছু নিতেন ২০ হাজার টাকা। তারপর তাঁর পারিশ্রমিক বেড়ে হয় ৫০ হাজার টাকা। সেখান থেকে বেড়ে লতা মঙ্গেশকরের পারিশ্রমিক গান পিছু দাঁড়ায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। আবার অনেক গানই রয়েছে যেগুলোর জন্য এক টাকাও পারিশ্রমিক নেননি সুরসম্রাজ্ঞী।

 

বাংলা সংগীতজীবন

এই সুরসম্রাজ্ঞী বাংলা ভাষায় মোট ১৮৫টি গান গেয়েছেন। ১৯৫৬ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর করা ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ গানের মাধ্যমে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। একই বছরে তিনি ভূপেন হাজারিকার সুর করা ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’ রেকর্ড করেন। যা ব্যাপক হিট হয়। পাঁচের দশকের শেষের দিকে, তিনি ‘যারে উড়ে যারে পাখি’, ‘না যেওনা’ এবং ‘ওগো আর কিছু তো নয়’ এর মতো হিট গান রেকর্ড করেছেন লতা। সবকটি গানই সলিল চৌধুরী রচিত? ১৯৬০ সালে, তিনি ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ রেকর্ড করেছিলেন। যা আজও বাঙালির প্রাণের খুব কাছের।

 

অভিনয়ে...

পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অংশগ্রহণ করতেন লতা। একদিন দ্বীননাথের নাটকে নারদ মুনির চরিত্রের অভিনেতা কোনো কারণে এসে পৌঁছাননি। তার আবার গানও গাওয়ার কথা। লতা বাবাকে এসে বললেন, তিনি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। প্রথমেই দ্বীননাথ তাঁর প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। ওই অতটুকু নারদ মুনিকে দেখতে যদি জোকার লাগে? লতার পীড়াপীড়িতে শেষটায় রাজি হলেন। লতার অভিনয় আর গান শেষে দর্শকরা “আবার চাই আবার চাই” বলে চিৎকার করেছিল সেদিন। লতার পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তার চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’ এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য ছোট একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। এ চলচ্চিত্রে দাদা চান্দেকারের রচনা করা গান ‘নাটালি চৈত্রাচি নাভালাল’ এ কণ্ঠ দেন তিনি। তবে চলচ্চিত্রের জীবনকে কখনো আপন করে নিতে পারেননি তিনি। একদিন কাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানান, এই কৃত্রিম অভিনয়ের জগৎ তাঁর আর ভালো লাগে না। লতা মঙ্গেশকর ১৩ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে প্রথম চলচ্চিত্র ‘মঙ্গলাগোরে’ অভিনয় করেছিলেন এবং কিছু সিনেমাতে তিনি নায়ক-নায়িকার বোনের ভূমিকাতেও অভিনয় করেছিলেন। তবে কখনো তার অভিনয় করতে ভালো লাগেনি। নয়টি ছবিতে গানের দৃশ্যের জন্য অভিনয় করেন তিনি।

 

এক দিনের স্কুলজীবন

লতা মঙ্গেশকর তার জীবনে শুধু এক দিনের জন্যই স্কুলে গেছেন। কথিত আছে স্কুলে ছোট বোন আশা ভোঁসলেকে সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন লতা। তারপর ক্লাসের মধ্যেই নিজের সহপাঠীদের গান শেখানো শুরু করেন তিনি। স্কুলের শিক্ষকরা এ কারণে তাঁকে শাসন করলে অভিমান করে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন লতা।

 

লতাকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা

১৯৬২-তে লতা মঙ্গেশকরকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় ১০ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় তাঁকে। বিষক্রিয়া পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে তার আরও তিন মাস লেগে যায়। কিন্তু এই হত্যাচেষ্টা কে করেছিল তা কখনো জানা যায়নি।

 

অপূর্ণ ইচ্ছা

এক সাক্ষাৎকারে লতা তার জীবনের দুটি অপূর্ণ ইচ্ছার কথা বলেন। প্রথমটি ছিল ভারতীয় গায়ক ও অভিনেতা কে এল সায়গলের সঙ্গে দেখা করা ও দ্বিতীয়টি ছিল অভিনেতা দিলীপ কুমারের জন্য গান করা। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা দুটি অপূর্ণই রয়ে যায়।

 

নেহরুর কান্না

চীন-ভারত যুদ্ধের সময় এক অনুষ্ঠানে ‘অ্যায় মেরি ওয়াতন কে লোগো’ গানটা শুনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলেন।

 

বিশ্বরেকর্ড

১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করার জন্য তার নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পায়। এ সময় তিনি প্রায় ৩০ হাজার গান রেকর্ড করেছিলেন।

সর্বশেষ খবর