মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সত্যজিৎ-মাধবীর অজানা সেই গল্প

সত্যজিৎ-মাধবীর অজানা সেই গল্প

১০ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রখ্যাত অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। এই দিনে কলকাতার জনপ্রিয় বিনোদন পত্রিকা ‘ইচড়ে পাকা’ এই অভিনেত্রীর জীবনের অজানা একটি দিকের গল্প প্রকাশ করে। গল্পটি ছিল বরেণ্য চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মাধবীর প্রেম।  বিষয়টি এখানে গ্রন্থনা করেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যেভাবে প্রেম বিচ্ছেদ

১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘চারুলতা’ সিনেমায় কাজ করেছিলেন মাধবী। যদিও এর আগে ‘মহানগর’ সিনেমাতেও একসঙ্গে কাজ করেছিলেন তারা। ‘চারুলতা’ সিনেমায় কাজ করতে করতেই একে অপরের কাছাকাছি চলে আসেন সত্যজিৎ এবং মাধবী। যদিও পরবর্তীকালে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অভিনেত্রী। ‘কাপুরুষ’ সিনেমার পর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আর কোনো সিনেমায় কাজ করেননি তিনি।

 

কেন দূরে সরলেন মাধবী

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করা তো দূরের কথা, তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সেই মানুষটাকে ভালোবাসতাম। তিনিও যে আমায় ভালোবাসতেন এ বিষয় নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আমাদের কারও একে অন্যের প্রতি কোনো প্রত্যাশা ছিল না কখনোই। ওকে দখল করার মানসিকতা ছিল না আমার।’ মাধবী জানিয়েছিলেন, ‘উনি বিবাহিত ছিলেন। একজন মহিলা হয়ে আর এক মহিলার ক্ষতি করতে চাইনি আমি। যাকে ভালোবাসতাম তিনি বিবাহিত ছিলেন, তার একটি সন্তান ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওর স্ত্রী আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলেন।’

 

আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন মাধবী

মাধবী বলেছিলেন, ‘একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে ৬০টা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম। হাসপাতালে চার দিন ছিলাম, তাও অজ্ঞান অবস্থায়। আমি যে মানুষটাকে ভালোবাসতাম তার ক্ষতি কোনো দিন চাইনি। আমার সঙ্গে তার নাম যোগ করে যখন কালিমালিপ্ত করা হচ্ছিল আমার মনে হয়েছিল নিজেকে শেষ করে দেওয়া অনেক সহজ।’

 

কী বলেছিলেন সত্যজিৎ সহধর্মিণী

সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায় ‘আমাদের কথা’ গ্রন্থে কোনো অভিনেত্রীর নাম না উল্লেখ করেই বলেছিলেন, তার স্বামী সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে নায়িকার স্ট্যান্ডার্ড একেবারেই মেলে না। বিজয়া দেবী কোনো নাম না উল্লেখ করলেও এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তিনি মাধবী দেবীর কথাই বলতে চেয়েছিলেন। মাধবী দেবীর সঙ্গে স্বামীর প্রেমের গুঞ্জন যে তাকে কষ্ট দিয়েছিল, সে কথাও বলতে ভোলেননি তিনি। বিজয়া রায় বলেছিলেন, তার আপত্তিতেই নাকি সত্যজিৎ রায় আর মাধবীর সঙ্গে কাজ করেননি।

 

জবাবে মাধবী

কিন্তু মাধবী বলেছিলেন, ‘অশনি সংকেত’-এ আমায় ডাকা হয়েছিল, আমি যাইনি। ‘নায়ক’-এও না বলেছি। ‘ঘরে বাইরে’র সময় এক সাংবাদিককে দিয়ে ডাক পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তখনো আমি যাইনি। আমি একবার না বললে সেটা কখনো হ্যাঁ হয়ে যায় না।

 

সেই প্রেম নিয়ে মাধবী

মাধবী বলেছিলেন, ‘মাধবী ও সত্যজিৎ প্রেম ও বিচ্ছেদ দুটো জিনিস মিশিয়ে ফেলা একেবারেই পছন্দ করি না। আমি তো চায়ের সঙ্গে কফি মিশিয়ে খাই না। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ না-ও হতে পারি, কিন্তু আমারও কিছু নীতি আছে। মাধবী সিনেমার জন্য সম্পর্কে জড়িয়েছিল, এটা কেউ বললে মেনে নিতে পারব না। আমার কাছে ভালোবাসা আর পেশা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো বিষয়। আমার ফিল্ম যদি দর্শকের পছন্দ না হয়, তাতেও আমার কোনো আফসোস থাকবে না। কিন্তু আমি যদি কাউকে ভালোবাসি, তা হলে তাকে শুধু ভালোই বাসব। তাতে কোনো শর্ত থাকবে না। ভালোবাসার সঙ্গে কোনো কিছু মেশাতে পারব না। আর এ কারণে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের ভালোবাসা অটুট ছিল।’ মাধবী আরও বলেন, সত্যজিৎ  একটা কথাই বলতেন, ‘আমি জীবনে এত কিছু অর্জন করেছি, এত সম্মান পেয়েছি। সমাজ কি আমার একটা ছোট্ট অপরাধ মেনে নেবে না?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না। এ সমাজ আপনার উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি। তাই এ সম্পর্ক কখনো মেনে নেবে না।’

 

সমাজের চোখে সেই প্রেম

মাধবী বলেন, ‘তিনি আমায় ভালোবাসতেন। আর সেটাই ছিল ওঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। সমাজের চোখে আমাদের সম্পর্ক অবৈধ ছিল। আমার মনে হয়, আমি যদি তখন বলতাম, এটা কোনো অপরাধ নয়, তা হলে সমস্যা কম হতো। ‘আগন্তুক’ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আমায় বিশেষ শোয়ে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আরও জানিয়েছিলেন, ‘চারুলতা’র পর তার সেরা ছবি ‘আগন্তুক’। আমি তাঁকে আমার শুটিংয়ের ব্যস্ততার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু, আমায় আসার জন্য জোর করেছিলেন। শোয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, তিনি কতটা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন। বুঝতেই পারছিলাম, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। এরপর তাঁকে নার্সিং হোমে দেখতে গিয়েছিলাম। তার পর উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

 

সত্যজিতের শেষযাত্রায় কড়া মেকআপে মাধবী

১৯৯২-তে সত্যজিৎ মারা যাওয়ার পরে হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে গেছিল খবর। সেদিনও সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পেলেন না মাধবী। তখন অবশ্য অভিনেতা নির্মল কুমারকে বিয়ে করেন তিনি। মাধবী সত্যজিৎ রায়কে শেষ দেখা দেখতে হাজির হলেন। তবে সবাই দেখল, বড্ড চড়া মেকআপ তার। শোকের পরিবেশে বেমানান, চোখে পড়ার মতোই। তাতে যদিও কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি, পরোয়া করেননি মাধবী। বিরক্ত হলেন অনেকেই। বাদ গেলেন না বিজয়া রায়ও। তিনি শোকের মাঝেও বিরক্তি প্রকাশ করলেন মাধবীর এই অদ্ভুত সাজের জন্য। প্রেস, মিডিয়া থেকে নিউজ চ্যানেল সবাই ছবি তুলল অতি মেকআপ করা মাধবীর।

সর্বশেষ খবর