শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বিদায়ের দিন আজ

কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে

‘গীতশ্রী’ খ্যাত অনবদ্য এক সংগীত পুরাধার নাম সন্ধ্যা মুখপাধ্যায়, যিনি একদিন আপন মনে গেয়ে উঠেছিলেন ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগনও গান শোনাবার’...তারপর গানে গানে সংগীত ভান্ডারকে অপূর্ব পূর্ণতা দিয়ে আবারও গেয়ে উঠলেন ‘মধুমালতী ডাকে ওই’... ২০২২ সাল, ৯০ বছর বয়সে মধু মালতীর ডাকে সাড়া দিয়ে আজকের দিনে পরপারে যাত্রা  তার, রেখে গেছেন অনেক কিছু তবুও বলে গেলেন ‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো...’ প্রয়াত সন্ধ্যার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

দৃশ্য-১, সময় রাত ৯টা

(ঠক ঠক ঠক। সদর দরজায় কে যেন ঘন ঘন কড়া নাড়ছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জ্ঞানেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত দরজা খুলে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধুবর ডাক্তার বিশ্বনাথ। কলকাতা করপোরেশনের কাউন্সিলর। খুব উত্তেজিত। হাঁপাচ্ছেন। বন্ধুকে প্রায় ঠেলেই ঢুকে এলেন ভিতরে)।

-বুঝলে, আজ একটা ব্যাপার হয়েছে।

-আরে বোসো, বোসো। এত উত্তেজনা কীসের?

-উফ, কী শুনে এলাম! এমন গলা আগে আর শুনিনি। বুঝলে, আজ যে আসরে গিয়েছিলাম, সেখানে স্টেজে উঠল একটা বাচ্চা মেয়ে। নতুন মুখ। কালো মতো,  রোগা, অতি সাধারণ চেহারা, দুই বিনুনি বাঁধা। শাড়ির আঁচলখানা গায়ে জড়িয়ে স্টেজে বসল। আমি ভাবলাম, এ আবার কী ক্ল্যাসিক্যাল গাইবে? চেহারা দেখে গাইয়ে বলে মনেই হয় না। আহা, চেহারার সঙ্গে গানের কী সম্পর্ক। কী বোকাই যে বনে গেলাম। তানপুরা মিলিয়ে নিয়ে মেয়েটা সুর ছাড়ল। সেই ভয়েস থ্রো শুনে তো আমি মোহিত। নিখুঁত, গোল আওয়াজ। যেমন মিষ্টি গলা, তেমনি টোনাল কোয়ালিটি। এমনটি আমি আগে আর শুনিনি। মেয়েটির নাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শুনলাম বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের ছাত্রী। উফ, ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ আর সুর। তার সঙ্গে সূক্ষ্ম কাজ। এ মেয়ে অনেকদূর যাবে, এই বলে দিলাম তোমায়। এ কাহিনি পঞ্চাশের দশকের। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা।

কেন ‘গীতশ্রী’ তকমা দেওয়া হয়েছিল

কিংবদন্তি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়  বরাবরই সংগীতমহলে ‘গীতশ্রী’ নামেই পরিচিত। সংগীতশিল্পীর নামের সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছিল এই তকমাটি। তাঁর দীর্ঘ সংগীতজীবনে অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন সন্ধ্যা। কিন্তু কেন কেবল ‘গীতশ্রী’ নামেই ডাকা হতো তাঁকে? কোন সম্মান পাওয়ার পর এই তকমাটি জুড়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার নামের সঙ্গে? ‘গীতশ্রী তকমার নেপথ্যে রয়েছে একটি কাহিনিী দিনটি ছিল ১৯৪৬ সালের ৬ এপ্রিল। সন্ধ্যা মুথোপাধ্যায় তখন সাড়ে ১৪ বছরের বালিকা। ‘গীতশ্রী’ নামে একটি পরীক্ষা হয়েছিল বাংলায়। সেটিতে অংশ নিয়েছিলেন ছোট্ট সন্ধ্যা। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি আয়োজিত এই সংগীত পরীক্ষায় বিচারক ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ মহম্মদ দাবির খাঁ এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই পরীক্ষায় কেবল সসম্মানে উত্তীর্ণই হয়েছিলেন তা নয়, প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। সন্ধ্যার গাওয়া গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিচারকরা। প্রথম স্থান অধিকার করায় তাঁকে ‘গীতশ্রী’ তকমা দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে সন্ধ্যা খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতিসহ একের পর এক আধুনিক গান গেয়েছেন। ১৯৫৪ সালে অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হন। সেই থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সবার কাছে হয়ে গেলেন ‘গীতশ্রী’।

 

লতার সান্নিধ্যে মজার গল্প...

১৯৫০ সালে অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তারানা’ ছবিতে গাইতে গিয়েই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয় হলো। গানটা ছিল লতার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে’ ‘বোল পাপিহে বোল রে, তু বোল পাপিহে বোল’। অভিনেত্রী মধুবালার লিপে লতার, সন্ধ্যার গান ছিল শ্যামার লিপে। পরিচয়ের কিছু দিনের মধ্যেই লতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে যায় সন্ধ্যার। লতা প্রায়ই চলে আসতেন এভারগ্রিন হোটেলে সন্ধ্যার কাছে। সাধারণ বেশভূষা, আন্তরিক ব্যবহার। লতাকে খুব ভালো লাগল সন্ধ্যার। লতা একলাই আসতেন, কখনোবা থাকতেন সুরকার রোশন, সি রামচন্দ্র। লতার সঙ্গে গান নিয়ে নানা আলোচনা হতো। তখন উচ্চাঙ্গ সংগীতের নামি শিল্পী রোশেনারা বেগম, হীরাবাই বরোদেকর, কেশরবাই বরোদেকর। রোশেনারার গান সবচেয়ে পছন্দ করতেন লতা। লতা আবার খুব ভালো অন্যের গলা নকল করতে পারতেন। সে সময়কার হিন্দি ছবির মহিলা শিল্পীদের গলা নকল করে শোনাতেন লতা সন্ধ্যাকে। প্রথম দিকে সন্ধ্যার সঙ্গে তাঁর দিদি ছিলেন। কয়েক মাস দিদি থেকে চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যার মা আসেন। মা নিজেই রান্না করতেন। হোটেলের খাবার খেতেন না। লতা মায়ের হাতের রান্না দারুণ পছন্দ করতেন। লতা এসে মাকে বলতেন, ‘মাইজি, আজ থোড়াসা চাউল লেঙ্গে।’ সন্ধ্যার মা লতাকে রেঁধে খাওয়াতেন নানা তরকারি, কোনো দিন আবার পায়েস। লতা খুব তৃপ্তি করে খেতেন সে সব। লতা সন্ধ্যার কাছে এসে অনেক সময়ই শুয়ে শুয়ে গল্প করতেন। বলতেন নানা সুখ-দুঃখের কথা। বলতেন কীভাবে কত কষ্ট করে স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। পুরনো ছেঁড়া চটি, কাপড় মাত্র দুটি। যেটা পরে বেরোতেন, রাতে ফিরে সেটাই কেচে বালিশের নিচে রেখে দিতেন, ইস্ত্রি হয়ে যেত। কোনো কোনো সংগীত পরিচালক বলতেন, ‘ইতনি পাতলি আওয়াজ?’ কিন্তু লতা দমবার পাত্রী নন। প্রতিভা যাঁর আছে তাঁকে আটকাবে কে? এসব কথা শুনে লতার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায় সন্ধ্যার। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যাও চলে যেতেন লতার বাড়ি। লতার মা খুবই ভালোবাসতেন সন্ধ্যাকে। লতা কফি খুব পছন্দ করতেন। এলাচ দিয়ে কফি তৈরি করতেন। নানা গল্প হতো। একরাশ চুল লতার। লতাকে বলতেন সন্ধ্যা কী সুন্দর চুল তোমার। তারপর লতা কোনো কাজে বেরোলে সন্ধ্যাকে নামিয়ে দিয়ে যেতেন হোটেলে। পরবর্তীকালে সন্ধ্যার ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও এসেছেন লতা।

 

চিরস্মরণীয় কিছু গান...

এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার। ‘পথে হলো দেরি’ ছবির এই গান আজ যেন অনুরাগীদের মনকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুলছে। ‘সবার উপরে’ ছবির ‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এ মাধবী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার।’ ‘পথে হলো দেরি’ ছবির আরও একটি জনপ্রিয় গান ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে।’ অনুরাগীরাও আজ তাঁকে মনে মনে এটাই বলছেন। ‘কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে।’ ‘চয়নিকা’ অ্যালবামের গান ‘মধুমালতী ডাকে আয়। ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবির গান ‘কি মিষ্টি দেখো মিষ্টি কি মিষ্টি এ সকাল।’ ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির গান ‘কে তুমি আমারে ডাকো, পলকে লুকায়ে থাকো।’ ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’। ভারাক্রান্ত মনে এই গানগুলো যেন আরও মনকে ভারী করে তুলছে অনুরাগীদের।

সর্বশেষ খবর