বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
সুচন্দার কথায়

কেন নির্মাণ হয়নি জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’

আলাউদ্দীন মাজিদ

কেন নির্মাণ হয়নি জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’

১৯৬৫ সাল। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। এ ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দিনটির সমগ্র ঘটনা তুলে ধরে মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের মতো মহতী কাজে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। ছবির শিরোনাম রাখা হয়েছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ছবিটি বানানোর সুযোগ দেয়নি তাকে।

শহীদ জহির রায়হানের সহধর্মিণী চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণভাবে একটি ধারণা আছে, এটি বুঝি নিছক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন। ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে যে ছবিটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তার কাহিনিতে তিনি তুলে ধরেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক-কৃষক-জনতার সম্পৃক্ততা। জহির রায়হানের কাহিনি অবলম্বনে বরেণ্য শিল্পী মুর্তজা বশীর ছবিটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। তাছাড়া সেই সময় কয়েকটি পত্রিকায় ছবিটির বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল।’

সুচন্দা বলেন, জহির রায়হান মুর্তজা বশীরের হাতে গল্পটি তুলে দেন চিত্রনাট্য তৈরির জন্য। এ গল্পে ছিল চারটি পরিবার, যারা সমাজের চারটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। একটি উচ্চবিত্ত, একটি মধ্যবিত্ত, একটি শ্রমিক ও একটি কৃষক দম্পতি, যারা ঘটনাচক্রে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে এমন একটি জায়গায় একত্রিত হন যেখানে ছাত্রদের মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। চিত্রনাট্যের শুরুতেই ছিল গুলির শব্দ, তারপরই একঝাঁক কাক আর্তকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে উড়ে বেড়ায় গোটা ঢাকা শহরের আকাশে। ধীরে ধীরে ফ্রেমে আসে রাজপথ, টাটকা রক্ত। 

কাহিনির প্রথমেই পাওয়া যায় কৃষক গফুরকে, যে নিজের বিয়ের বাজার করবে বলে ঢাকা শহরে এসেছে এবং ‘হরতাল’ নামক আজব জিনিস দেখার জন্য রাতেও  থেকে যায়। এরপর পাওয়া যায় আহমেদ হোসেনকে, যিনি পুলিশের লোক এবং তার ছেলে তসলিম সরকারবিরোধী ছাত্ররাজনীতি করে বলে তার প্রমোশনটা আটকে আছে। এককালের কবি আনোয়ার হোসেন এখন  কেরানি, যিনি চাকরি হারানোর ভয় থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদের হরতালকে সমর্থন  দেন। তার স্ত্রী গৃহিণী, নিজের সংসারের ভালোমন্দ ছাড়া আর কিছু সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহও নেই, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে শুনে যিনি আঁতকে ওঠেন, ‘সে কীগো! আমরা তাহলে কোন ভাষায় কথা বলব?’। অর্থ ও প্রাচুর্যের অফুরন্ত সমাবেশের মকবুল আহমেদকে বলতে দেখা যায়- ‘বাংলা কি মুসলমানের ভাষা নাকি? ওটা তো হিন্দুদের ভাষা’। সব শেষে পাই রিকশাচালক সেলিমকে যার স্বপ্ন একটা রিকশা কেনার, যিনি রুজি  রোজগারের জন্য হরতালের বিরোধী, আবার বাংলা বিষয়েও দরদি। এদের সবাইকে পাওয়া যায় একযোগে এক স্থানে ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ, তন্মধ্যে গফুর, তসলিম ও আনোয়ারকে আমরা হারিয়ে ফেলি চিরতরে। কৃষক গফুর, পুলিশ আহমেদ হোসেন, ছাত্র তসলিম, সরকারি  কেরানি আনোয়ার হোসেন, পুঁজিপতি মকবুল ও রিকশাচালক সেলিম সবাই সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে তাদের সবাইকে জড়ো করা হয়েছে একই স্থানে যেখানে গুলি করা হচ্ছে। যে গুলির শব্দ শুনে ‘কাকগুলো চিৎকার থামিয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। তারপর একটা কাক ভয়ার্ত ডানা মেলে আকাশে উড়ল’।

নবারুণ ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। ‘একুশে  ফেব্রুয়ারি’ ছবিটিতে কারা অভিনয় করবেন তাও চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল খান আতা, সুমিতা দেবী, রহমান, শবনম, আনোয়ার, সুচন্দা, কবরী প্রমুখ শিল্পীর। ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে জহির রায়হান চিত্রনাট্যটি এফডিসি স্টুডিওতে জমা দেন অনুমোদনের জন্য। কিন্তু এ ছবি নির্মাণের অনুমতি তাকে  দেওয়া হয়নি। ছবিটির চিত্রনাট্য জমা দেওয়ার পর প্রশাসন এটি অনুমোদন দিতে আপত্তি জানায়। অনুমোদন পাওয়ার জন্য বছরখানেক  চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন জহির রায়হান। সব আশা ত্যাগ করে ছবিটির চিত্রনাট্য তিনি ফেরত চান। কিন্তু চিত্রনাট্যটি তাকে আর ফেরত  দেওয়া হয়নি। তৎকালীন এফডিসি কর্তৃপক্ষ পরে তাকে জানায়, এটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছবিটির চিত্রনাট্যকার শিল্পী মুর্তজা বশীর অবশ্য মনে করেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ছবিটির চিত্রনাট্য এফডিসির আর্কাইভেই আছে। ভালো করে খুঁজলে হয়তো সেটা এখনো পাওয়া যেতে পারে। সুচন্দা জানান, ছবিটির অনুমোদন লাভে বহু দেনদরবার করেও জহির রায়হান ব্যর্থ হন। এমনকি তাকে ছবির চিত্রনাট্য ফেরত দেওয়া হয়নি।  

ছবিটি নির্মাণ করতে না পারায় এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে জহির রায়হান বলেছিলেন, স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে মনে হচ্ছে আমার একটি স্বপ্নের মৃত্যু হলো। সুচন্দা আরও জানান, সাময়িকভাবে হতাশ হলেও জহির রায়হান জীবনের শেষ দিনেও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ছবিটি নির্মাণের ইচ্ছা ত্যাগ করেননি। এ বিষয়ে জহির রায়হান সব সময়ই বলতেন, ভাষা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে আমি বাঙালি জাতির দরবারে কোনো না  কোনো দিন হাজির হবই। সুচন্দা দাবি করেন, এফডিসিতে সঠিকভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে মূল চিত্রনাট্যটি খুঁজে বের করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার। জহির রায়হানের লেখা মূল গল্পটি আজও রয়ে  গেছে। প্রয়োজনে সেই গল্প অবলম্বনে আবার চিত্রনাট্য রচনা করা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনের মতো বিশাল ইতিহাস নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র  নেই। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নির্মাণ করে সেই অভাব দূর করা যাবে। সরকার যদি এর জন্য ন্যূনতম অনুদানের ব্যবস্থা করে তাহলে সুচন্দা নিজেই কাজটি শুরু করতে চান। বাস্তবায়ন করতে চান জহির রায়হানের স্বপ্ন।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি তৈরির সুযোগ পাননি জহির রায়হান। তবে এজন্য জহির রায়হান পিছপা হননি। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ও পশ্চিম পাকিস্তানের  স্বৈরশাসকদের চিত্র তুলে ধরার জন্য ‘একুশে  ফেব্রুয়ারি’ ছবিটি বানাতে না পারলেও বানিয়েছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। এ ছবিতে ঠিকই তিনি একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তুলে ধরেন। ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি রিলিজ পেলে বাঙালি দর্শক বুঝতে পারে, পাকিস্তানিদের শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিরূপ। গণমত গড়ে উঠল, পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর নয়। দলে দলে মানুষ এ ছবিটি দেখার পর সবার মুখেই ফিরতে লাগল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’।

সুচন্দা আরও জানান, একাত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘আগামী গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত হবে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে নিজেদের তাগিদে একটা ছবি করা। বাংলার জন্য যাদের প্রাণ এত কাঁদে, তারা একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর একটা ছবি করবে না, যে একুশেতে বাংলা পুনর্জন্ম লাভ করেছে। তাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব তো হবে এটা’। সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘একুশের ওপর ছবি করা আমার জীবনের অন্যতম প্রধান বাসনা’। উপরোক্ত দুটো বাসনার কোনোটা কি পূর্ণ হয়েছে? আমাদের দায়িত্বটা কি আমরা পালন করতে পেরেছি? হাজার বছরের পুরনো রাতটা কিন্তু বেড়েই চলছে।

সর্বশেষ খবর